উৎপাদন ঘাটতি, কৃষকদের ধীরে চলোনীতি, হাতবদলের কারণে দাম বৃদ্ধি ও আমদানি বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে অস্থির হয়ে ওঠেছে দেশের পেঁয়াজের বাজার। গত দুই সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত বছরের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম ৭৮ শতাংশ বেশি। আগামী বর্ষা মৌসুম ও ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে পেঁয়াজের বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন সাধারণ ভোক্তারা। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, পেঁয়াজের উৎপাদন কিছুটা কম হলেও তা উদ্বেগের কিছু নেই। চাহিদা অনুসারে দেশে পেঁয়াজ উৎপান হয়েছে, যা আগামী মৌসুম পর্যন্ত চলবে।
কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষকদের হিসেবে চলতি বছর পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ২৪-২৫ টাকা। অন্যান্য খরচ মিলিয়ে কৃষককে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হয় ন্যূনতম ৩০ টাকা। তবে মৌসুমের শুরুর পর থেকে গত এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ১৭-১৯ টাকা কেজি। ক্রমাগত লোকসান দিয়ে কৃষক এখন সতর্ক হয়ে গেছে। মৌসুম শেষ হতেই তারা লোকসানে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দেন। এতে পেঁয়াজের সরবরাহ কিছুটা টানা পড়ে। হঠাৎ সরবরাহ ঘাটতিতে ফরিদপুরসহ পেঁয়াজের প্রধান অঞ্চলগুলোতে দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যদিও এখন আবার কিছুটা কমছে।
তবে ভোক্তা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারন হাতবদলে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি। পেঁয়াজের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত তিন বদল হয়, যার প্রতিটিতেই ন্যূনতম ১০ টাকা করে দাম বাড়ে।
ফরিদপুরের বোয়ালমারি, চিতার বাজার, মইন দিয়াসহ বিভিন্ন পেঁয়াজের হাটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদের পর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। সপ্তাহ খানেক আগেও পেঁয়াজের দাম বেড়ে ২০০০-২১০০ টাকা মণ (৪১ কেজি) বা ৪৯-৫২ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল। তবে বর্তমানে ১৭০০-১৮০০ টাকা বা ৪২-৪৪ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। কিছুটা নিম্নমানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩২-৩৫ টাকা কেজি।
কৃষকদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার গতবছরের তুলনায় পেঁয়াজের ফলন কিছুটা কম হয়েছে প্রায় প্রতিটি কৃষকেরই। গত বছরও প্রতি শতকে প্রায় ২ মণ পেঁয়াজ পাওয়া গিয়েছিল। চলতি বছর সেটা ১-১.৫ মণে নেমে এসেছে। ফলে সার্বিক উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে পেঁয়াজের অঞ্চলগুলোতে। এটি পেঁয়াজের মৌসুমে বৃষ্টি, বিরূপ আবহাওয়া ও আমদানি করা কিছু নিম্নমানের বীজের কারণে হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষকরা। তবে গতবছরের তুলনায় পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হতে পারে।
ফরিদপুরের বোয়ালমারির কৃষক মো. মিজানুর রহমান বলেন, এবার যারা আমদানির করা পেঁয়াজ বীজ দিয়ে চাষ করেছেন, তাদের ফলন কিছুটা কম হয়েছে, এতে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। কিন্তু মৌসুমে কৃষক পেঁয়াজ বিক্রি করছে লোকসানে। তখন তাদের নগদ টাকার খুবই দরকার ছিল। কিন্তু এখন যখন নগদ টাকার চাহিদা কিছুটা কমেছে তাই কৃষক লোকসানের পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন।
ডিএই’র উপপরিচালক ও ফরিদপুর অফিসের প্রধান মো. জিয়াউল হক বিজনেস পোস্টকে বলেন, আমাদের হিসেবে কৃষকের পেঁয়াজ উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা প্রতি কেজি। সে ক্ষেত্রে কৃষক অন্যান্য খরচ যোগ করে কৃষককে ৩০ টাকার বেশি দামে বিকি করতে হয়। এর নিচে বিক্রি করলে কৃষকের লোকসানই বলা চলে। সে হিসেবে এখন কৃষক প্রফিটে রয়েছেন, কয়েক সপ্তাহ আগেও লোকসানে ছিলেন তারা।
তিনি বলেন, সিতরাংয়েল কারণে এবার অনেক চাষিকে পেঁয়াজ আবাদ শুরু করতে হয়েছে দেরিতে। এছাড়া স্থানীয় বীজ ছাড়া বাইরের বীজ যারা ব্যবহার করেছে তাদের কিছুটা সমস্যা হয়েছে। সবমিলিয়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজের ফলন কিছুটা কম হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে পেঁয়াজ আমরা খাচ্ছি সেই হালি পেঁয়াজের ফলন স্বাভাবিক রয়েছে। ফলে পেঁয়াজের ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।’
ফরিদপুরের মইন দিয়া এলাকার চাষি হাজী চুন্নু মোল্লা বলেন, আমি এবার মোট ১৩৫ শতক জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছিলাম। নিজে শ্রম দিয়েও প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৫০ মণ পেঁয়াজ। সে হিসেবে প্রতি কেজি পেঁয়াজের প্রাথমিক উৎপাদন খরচ ১৭ টাকা। এর সঙ্গে নিজেদের শ্রম, পচে যাওয়ার কারণে কিছু লোকসান ও সংরক্ষণ খরচ ও হাটে নেয়ার পরিবহন ভাড়া হিসাব করলে পেঁয়াজের বিক্রি মূল্য ন্যূনতম ৩০ টাকা হওয়া লাগবে।
এছাড়া যারা বর্গা নিয়ে পেঁয়াজ চাষ করেন তাদের খরচ আরও বেশি হয়। কারণ জমির মালিককে তিন ভাগের একভাগ পেঁয়াজ দিয়ে দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে বর্গচাষির প্রাথমিক খরচ ২৫ টাকা প্রতি কেজি।
তবে কৃষি সম্প্রসাণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মাহপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলছেন পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কম হলেও দেশের চাহিদা পূরণ করার মতো পেঁয়াজ রয়েছে। যদিও কিছু ঘাটতি হয় তবে সেটা বছরের শেষ দিকে হতে পারে। তত দিনে আগামী মৌসুমের আগাম পেঁয়াজ বাজারে চলে আসবে।
বিজনেস পোস্টকে তিনি বলেন, এবার পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৬ লাখ টন, তবে উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ টনের কিছু বেশি। এবার আমাদের পোস্ট হারভেস্ট লস কম হয়েছে। ফলে আমাদের বছরের চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে। আমদানির তেমন প্রয়োজন নেই।
কৃষক পর্যায়ে দাম কিছুটা না বাড়লে তারা লোকসানে পড়েন। তাই কৃষক যাতে উৎপাদন খরচের উপরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারেন সে দিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে মনে করছেন তিনি।
দামের পার্থক্য:
পেঁয়াজের মোকামগুলোতে গড়ে ৩২-৪৪ টাকা বিক্রি হলেও এক হাত ঘুরেই সেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাচ্ছে কেজিপ্রতি ১০ টাকার বেশি। গত সোমবার ও মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারের আড়তগুলোতে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫২-৫৪ টাকা কেজি। রাজধানীর সেগুনবাগিচা, রামপুরা, মানিকনগরসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায় খুচরায় দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা কেজি।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) হিসেবে গত বছর এই সময় খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৩০-৪০ টাকা কেজি। সে হিসেবে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭৮ শতাংশ।
কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজের আড়তদার মো. খলিল বলেন, পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ রয়েছে। দেশি পেঁয়াজের সরবরাহও কমে গেছে। তাই দামও বেড়েছে। তবে আমরা পেঁয়াজ বিক্রি করি কমিশনের ভিত্তিতে। পেঁয়াজ কৃষক বিক্রির পর সেখানকার স্থানীয় পাইকাররা এক সঙ্গে পরিবহনে করে ঢাকায় এনে আড়তে রাখেন। আমরা তাদের পণ্য বিক্রি করে কেজিপ্রতি ১ টাকা আড়তদারি পাই মাত্র। আমরা বিক্রির পর বড় ঢাকার খুচরা বিক্রেতারা কিনে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। ঢাকার বাইরে হলে আরও এক হাত বেশি ঘুরে।