বেসরকারি চাকরিজীবী সোহেল রানা। নিজের কষ্টার্জিত অর্থের একটি অংশ সঞ্চয় করছিলেন ইসলামী ব্যাংকে। ২০২৪ সালে তার মুদারাবা মেয়াদী সঞ্চয় ম্যাচিউর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঋণের অনিয়ম নিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ দেখে চিন্তায় পড়ে যান তিনি। তাই গত বৃহস্পতিবার আমানত ম্যাচিউর হওয়ার আগেই টাকা উত্তোলন করে ফেলেন।
সোহেলের মতোই রাজধানীর আরেক বাসিন্দা রোকেয়া রহমান। পেশায় তিনি একজন এসএমই উদ্যোক্তা। আইবিবিএলে নিজের মেয়াদী সঞ্চয় আমানত ম্যাচিউর হওয়ার আগেই তিনিও ভেঙ্গে ফেলেন। কারণ শরিয়াহভিত্তিক এ ব্যাংকটি নিয়ে তিনিও এখন আতঙ্কিত।
আইবিবিএলের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, সোহেল রানা এবং রোকেয়া রহমান বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। কারণ পুরো নভেম্বর মাসজুড়েই আতঙ্কিত আমানতকারীরা এ ব্যাংক থেকে তাদের অর্থ উত্তোলন করছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান, মতিঝিল এবং ঢাকার অন্যান্য এলাকায় আইবিবিএলের বিভিন্ন শাখা পরিদর্শন করেন বিজনেস পোস্টের এ প্রতিবেদক। এসময় তিনি ব্যাংকের প্রত্যেকটি শাখায় অর্থ উত্তোলনের জন্য আমানতকারীদের লাইন দেখতে পান।
ইসলামী ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে আইবিবিএলে নগদকরণ আমানতে মারাত্মকভাবে প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরের নভেম্বরের শেষে আমানত ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৭২ দশমিক ৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। যা অক্টোবরের শেষে ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।
পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের আমানত কমেছে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে আইবিবিএলের আমানত ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা।
দেশে কোভিড-১৯ মহামারি শুরু সময় ব্যাংকটির ২০২০ সালের জুনে আমানত ১ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। এর আগে ২০১৯ সালে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছেিল ৯৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বৃহত্তম এ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিনিয়োগ বা ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইবিবিএলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকটির বিনিয়োগ বা ঋণ প্রকৃতপক্ষে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা।
আইডিআর সীমা লঙ্ঘন করেছে আইবিবিএল
সাম্প্রতিক অতিরিক্ত ঋণ কার্যক্রমের কারণে ব্যাংকটি ইতোমধ্যে তার আইডিআর (বিনিয়োগ আমানত অনুপাত) সীমা লঙ্ঘন করেছে।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংক তাদের মোট আমানতের ৯ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) এবং সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) হিসাবে রাখতে হবে। এর পরে ঐ ব্যাংকের তার আমানতের ৯২ শতাংশ ঋণ দেওয়ার অনুমতি থাকে।
এই সূত্রে, আইবিবিএল এ বছরের নভেম্বরে তাদের ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৭২ দশমিক ৭ কোটি টাকা আমানত থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। কিন্তু এ পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৫ কোটি।
দ্য বিজনেস পোস্ট আইবিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মোহাম্মদ মনিরুল মওলার সাথে ফোনে এবং টেক্সট বার্তার মাধ্যমে এই বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এই প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত তিনি কোনো সাড়া দেননি।
আইবিবিএলের ঋণ অনিয়ম
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১১ ভুতুড়ে এবং নামহীন কোম্পানিকে ৯ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে ইসলামী ব্যাংক। পর্যবেক্ষক প্রত্যাহারের পরও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যার অধিকাংশ অনুমোদন হয়েছে। এরপরই বিতর্কের মুখে পড়ে ব্যাংকটি।
চলতি বছরের ৫ জুন ইসলামী ব্যাংকের ১৯৭০ তম নির্বাহী কমিটির সভায় নতুন গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডকে ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে বিতরণের জন্য ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে।
সেই সময়কালে কোম্পানির সিআইবি’র (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) তথ্য অনুসারে, বেশ কয়েকটি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৮.৫ লাখ টাকার এক্সপোজার ছিল কোম্পানিটির।
পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অভ্যন্তরীণ ক্রেডিট রিস্ক রেটিং সিস্টেম (আইসিআরআরএস) অনুযায়ী কোম্পানিটি প্রান্তিক শ্রেণীর (নতুন কোম্পানি) অন্তর্গত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কোম্পানিটির কাছ থেকে আমানত হিসেবে ১১০ কোটি টাকাসহ জামানত হিসেবে আইবিবিএলের অন্তত ২৩০ কোটি টাকা নেওয়া উচিত ছিল। সহজ ঋণের শর্তে এই ধরনের সিকিউরিটি বাধ্যতামূলক নয়, তাই ঋণগুলি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
নাবিল ফিড মিলস লিমিটেডকে ৭০০ কোটি টাকাসহ নাবিল গ্রুপের বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে ইসলামি ব্যাংক রাজশাহী শাখা।
সভার কার্যবিবরণীতে ব্যাংকটি দাবি করেছে, নাবিল ফিড মিলস লিমিটেড এবং নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেড একই গ্রুপের কোম্পানি নয়। তবে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানই নাবিল গ্রুপের বলে সন্দেহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দুটি প্রতিষ্ঠানই যদি নাবিল গ্রুপের হয় তাহলে একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করেছে ইসলামি ব্যাংক। যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন।
তবে সাম্প্রতিক সরকারি নির্দেশের পর ওইসব কোম্পানিকে দেয়া ৯ হাজার ১৩৫ কোটি টাকার ঋণ স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে, আইবিবিএল এর অ-পারফর্মিং লোন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষে ছিল ৩ হাজার ৫২৫ দশমিক ৯১ কোটি টাকা ছিল।