প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে বিলুপ্তির পথে বাঁশির সুর

২৩ নভেম্বর ২০২১ ১৩:৫৮:৪৯ | আপডেট: ৩ years আগে
আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে বিলুপ্তির পথে বাঁশির সুর
রাজধানীর আল্পনা প্লাজার দোকানে বাঁশি বাজাচ্ছেন বিক্রেতা। ছবি: রাজীব ধর

তাশরিফা তৃষা

এক সময় পথে পথে বাঁশি বাজিয়ে বাঁশের বাঁশি বিক্রির দৃশ্য ছিল খুব স্বাভাবিক। মনোমুগ্ধকর সুর তুলে তারা হেঁটে বেড়াতেন রাজধানীসহ নানা প্রান্তে, বিক্রিও হতো অনেক। কিন্তু সময় বদলেছে, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিভিন্ন আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের জনপ্রিয়তা বাড়ায় এখন হারাতে বসেছে এ পেশা। 

আসলে এ কাজে কতজন জড়িত, সে সম্পর্কে সরকারি কোনো তথ্য না থাকলেও আগের চিরচেনা দৃশ্য এখন বিরল।

বিলুপ্ত প্রায় এ পেশার সাথে জড়িত কয়েকজনের মধ্যে গনি মিয়া একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দোয়েল চত্বরের কাছে ফুটপাতে হাঁটার সময় বাঁশি বাজাচ্ছিলেন ৭০ বছর বয়সী এ বৃদ্ধ। তিনি প্রায় ৮০টি বাঁশের বাঁশি বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন।

দ্য বিজনেস পোস্ট’কে তিনি বলেন, আমি কিশোর বয়সে আমার গ্রামে যাত্রাপালায় রাখালের ভূমিকায় অভিনয় করতাম। তখন থেকেই বাঁশির সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

তার বাড়ি সাতক্ষীরায়, তবে তিনি এখন তার ছেলে সবজি ব্যবসায়ীর সাথে গুলিস্তানে থাকেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সাতক্ষীরা ছেড়ে আসেন, এরপর আর সেখানে ফেরা হয়নি।

তিনি জানান, বাঁশি বাজাতে তিনি খুব ভালোবাসেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশের রাস্তায় বসে এটি বাজাতেন। তাকে ঘিরে নানা বয়সী মানুষ ভীড় হতো। 

এ বৃদ্ধ বলেন, তারা আমার বাঁশির সুরের খুব প্রশংসা করতো, টাকাও দিতো, কিন্তু এখনকার দৃশ্য ভিন্ন। মানুষ এখন আমার বাঁশির সুরে মনোযোগী হয় না, তারা আমার এ অস্তিত্বকেও গুরুত্ব দেয় না।

যুবক বয়সের কথা মনে স্মরণ করে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী বাঁশির সুর শুনেই আমার প্রেমে পড়েছিল। সে ১২ বছর আগে মারা গেছে, কিন্তু আমি এখন বাঁশি সুরের মাঝেই তাকে অনুভব করতে পারি। আমার মনে হয়, স্ত্রী এখনও আমার পাশেই আছে।

তিনি বাঁশি বিক্রি করলেও নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতে চান না। তিনি বলেন, আমি শিল্পী।

এ বাঁশি বিক্রেতা বলেন, যদি আমি ব্যবসায়ী হতাম, আমি অবশ্যই আমার পেশা পরিবর্তন করতাম। সারাদিন হেঁটে যাই, বাঁশি বাজাই, আর মানুষকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমি ওই যে বলেছি, বাঁশির সুর আর নগরবাসীকে এখন আনন্দ দেয় না।

তিনি আরও বলেন, তরুণরা যখন তার কাছ থেকে বাঁশি কিনতে চায়, তখন তিনি অভিভূত হন। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তার বাঁশি তার কাছেই রাখতে চান বলেও জানান তিনি।

ধানমন্ডি লেকের পাশের আরেক বাঁশি বিক্রেতা আব্দুল মতিন জানান, তিনি আকার ভেদে বাঁশের বাঁশি ৮০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করেন। কিন্তু ৫৯ বছর বয়সী ওই বিক্রেতা বলেন, মানুষ আজকাল আর বাঁশের বাঁশি কেনে না।

তিনি বলেন, আমি এখানে সকালে এসেছি, এখন বিকেল হয়ে গেছে, কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত একটি বাঁশিও বিক্রি করতে পারিনি।

সঙ্গীত শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে বাঁশি কেনে, তবে খুব কম। তিনি বলেন, মানুষ এখন রাস্তার বিক্রেতাদের কাছ থেকে কেনার চেয়ে যন্ত্রের দোকানে যাওয়া এবং বাঁশির জন্য বেশি দাম দিতেও দ্বিধাবোধ করে না।

তিনি বলেন, এটি আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।

নিউ এলিফ্যান্ট রোডের আল্পনা প্লাজার লাবু বাঁশির মালিক লাবু মিয়া দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ২০১৬ সালে ব্যবসা শুরু করার সময় তিনি ব্যাপক সাড়া পেয়েছিলেন, কিন্তু এখন তিনি লোকসানে আছেন।

তিনি বলেন, মানুষ বেশিরভাগই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ছবি বা ভিডিও আপলোড করার জন্য আমার দোকানে আসেন, কিন্তু তারা বাঁশি কে নে না, বাঁশি কেনার প্রকৃত গ্রাহকের সংখ্যা আসলে খুবই কম।

এ ব্যবসায়ী জানান, তার বাবা ছিলেন বাঁশি বিক্রেতা। বাবার মৃত্যুর পর থেকে তিনি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ছেলে তাকে সহযোগিতা করে।

যারা তার দোকান থেকে বাঁশি কেনেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, সঙ্গীত শিক্ষক, ছাত্র, গায়ক ও যন্ত্র বাদক। তাদের মতে, এটা মেনে নেয়া কঠিন, কিন্তু সত্য হলো- আমাদের বাঁশির ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ শোয়েব দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, আজকাল যন্ত্রের আধুনিকীকরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যদিও যন্ত্র চালন শেখার জন্য মানুষের নিষ্ঠা ও ধৈর্য কমছে। সে কারণেই বাঁশের বাঁশির আবেদন কমে আসছে বলেও মনে করেন তিনি।