প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

আর্থিক স্কিম থেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন প্রবাসীরা

শাহীন হাওলাদার ও তালুকদার ফরহাদ
০১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৭:২০:২৯ | আপডেট: ২ years আগে
আর্থিক স্কিম থেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন প্রবাসীরা

প্রবাসীরা দেশের আর্থিক স্কিমে বিনিয়োগ করার চেয়ে তুলে নেয়ার দিকেই বেশি মনোযোগী হয়েছেন। গেল অর্থবছরে তারা প্রবাসী বন্ডে ১০৪.০৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেও বন্ড বিক্রি করে ২৫১.৮১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন। অর্থাৎ প্রবাসী বন্ডে নিট বিনিয়োগ ছিল ঋণাত্মক ১৪৭.৭২ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারেও তাদের বিনিয়োগ প্রবণতা কমছে। ৫ বছর আগে যেখানে পুঁজিবাজারে প্রবাসীদের বার্ষিক নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮০ মিলিয়ন ডলার, গেল অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ১১৪ মিলিয়ন ডলারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার পর দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কথা থাকলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মত বৈশ্বিক সংকট, আর্থিকখাতে নানা অনিয়ম, মূল্যস্ফীতির চাপ, সুদের হার না বাড়া, বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সীমা বেঁধে দেয়ার মতো সিদ্ধান্তের ফলে প্রবাসীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্স বাংলাদেশি-এর চেয়ারপার্সন শেকিল চৌধুরী দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগ সীমা বেঁধে দেয়ার কারণে বড় আকারের বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

বিনিয়োগসীমা বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্তকে হঠকারী বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, ‘‘প্রবাসী বন্ড অনেক পপুলার ছিল। সরকারের হঠকারি সিদ্ধান্তের কারণে এই স্কিম থেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন তারা।”

এছাড়াও চলমান অর্থনৈতিক সংকটও প্রবাসীদেও আর্থিক স্কিমে বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার কারণ বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

আর্থিকখাতের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দুর্নীতির কারণেও প্রবাসীরা দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা আতঙ্কে ভুগছেন বলে মনে করেন শেকিল চৌধুরী।

তিনি বলেন, বর্তমানে আর্থিকখাতে যে মিস ম্যানেজেমেন্ট হচ্ছে তাতে প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। তাই তারা তাদের বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কিত। এছাড়াও আইনকানুনের দুর্বলতার জন্য দেশে থাকা সম্পত্তির নিরাপত্তা নিয়েও প্রবাসীরা আস্থাশীল নন। এসব কারণেই তাদের বিনিয়োগ কমছে।

এদিকে ২০২১ সালে প্রবাসীদের জন্য বন্ডে সমন্বিত বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা এক কোটি টাকা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এছাড়াও ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করলে পাওয়া যেত সিআইপি মর্যাদা।

তবে চলতি বছরে ডলার সংকট কাটাতে ও বন্ডে প্রবাসী বিনিয়োগ উৎসাহী করতে সীমা তুলে দেয়ার পাশাপাশি ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের শর্ত তুলে দেয়া হয়েছে।

বিনিয়োগ সীমা তুলে দেয়ার বিষয়টি প্রবাসীদের জানানো তথা প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর।

সীমা তুলে নিলেও গেল অর্থবছরে বন্ডে বিনিয়োগ বাড়েনি, উল্টো বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন প্রবাসীরা।

ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে গেল অর্থবছরে প্রবাসীরা ১.৬ মিলিয় ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে তুলে নিয়েছেন ১২.৫৫ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ নিট বিক্রি ঋণাত্মক ১০.৯৫।

অন্যদিকে, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে ১০.৭৭ মিলিয়ন ডলার কিনলেও ১০৩.৫৭ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে দিয়েছেন। অর্থাৎ এই বন্ডে গেল অর্থবছরে নিট বিক্রি ছিল ঋণাত্মক ৯২.৮ মিলিয়ন ডলার।

আর ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে ৯১.৭২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে তুলে নেয়া হয়েছে ১৩৫.৬৯ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ নিট বিক্রি ঋণাত্মক ৪৩.৯৭ মিলিয়ন ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছরে বন্ডে বিনিয়োগ কমলেও গেল ৫ বছরের হিসাবে দেখা যায়, প্রবাসীরা বন্ডে ৯৮৫.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে ৫১১.৬৫ মিলিয়ন বিক্রি করে তুলে নিয়েছেন, অর্থাৎ নিট বিক্রি ছিল ৪৭৩.৮৫ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ্ উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘‘বর্তমানে যেসব স্কিম আছে সেগুলোতে প্রবাসীদের বিনিয়োগে আগ্রহ কম থাকার কারণ- এসব স্কিমে বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্ন খুবই কম। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, প্রবাসীদের বিনিয়োগ সুবিধায় আকর্ষণীয় স্কীম অর্থাৎ বন্ড আছে। গুটি কয়েক প্রবাসী এসব বন্ডে বিপুল বিনিয়োগ করায় এতে বিনিয়োগ সীমা করা হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু প্রবাসী এসব বন্ডে বিনিয়োগ করে ব্যাপক সুবিধা নিচ্ছেন। তাই বিনিয়োগের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল।”

উল্লেখ্য, প্রবাসীদের বিনিয়োগের জন্য ১৯৮১ সালে চালু করা হয় পাঁচ বছর মেয়াদি ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড। আর ২০০২ সালে তিন বছর মেয়াদি ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড চালু করা হয়।

বর্তমানে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের সুদের হার ১২ শতাংশ। আর ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে সুদের হার সাড়ে ৭ শতাংশ ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে সাড়ে ৬ শতাংশ।

অপরদিকে প্রবাসীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রবণতা কমছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গেল অর্থবছরে তাদের নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১১৪ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৪৫.৪৫ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২০৯ মিলিয়ন ডলার।

এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৯১ মিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২৪ মিলিয়ন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৭৯ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ১৭৯ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গেল ৫ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে প্রবাসীদের নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার।

এই বিনিয়োগ আরো কমবে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রবাসীরা ও বিদেশিরা তখনই বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আসে যখন বিদেশে ইন্টারেস্ট রেট কম থাকে এবং আমাদের পুঁজিবাজার নিম্নমুখী থাকে।

তিনি আরও বলেন, ‘‘ফেড ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ড নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং বিনিয়োগ ওদিকে চলে যাচ্ছে। আবার যখন ইন্টারেস্ট রেট কমবে এবং আমাদের বাজার নিম্নমুখী থাকবে অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত সস্তায় শেয়ার কেনা যাবে তখন তারা বিনিয়োগ বাড়াবে। এটা বাড়তে আরো ১/২ বছর সময় লাগবে বলে মনে হয়।”