মশিউর জারিফ
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে বিপণিবিতানগুলো পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসলেও সেভাবে জমে ওঠেনি ঈদ কেনাকাটা। ২ বছর মহামারির কারণে ভিন্ন চিত্র দেখা গেলেও এবার যেন স্বাভাবিকরুপে ফেরার চেষ্টায় বিপণিবিতানগুলো। কিছুটা হলেও মহামারির রেশ কাটিয়ে এবারের ঈদকে ঘিরে দেশজুড়ে বইছে উৎসবের হাওয়া। যত ঘনিয়ে আসছে ঈদ ক্রেতাসাধারণের উপস্থিতিতে রাজধানীর শপিংমল ও মার্কেটগুলো তত মুখরিত হয়ে উঠছে। নতুন নতুন মডেলের সাজ-পোশাকের পসরা সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন দোকানিরা।
ঈদের বাজারে অধিকাংশ ক্রেতাই শিশু না হয় তরুণ-তরুণী। পোশাক পছন্দ করার ক্ষেত্রে ফ্যাশন হাউসগুলো তারুণ্য আর ট্রেন্ডের কথা-ই মাথায় রাখে। কিন্তু দুই বছর মহামারির প্রকোপের পর এবার কোন ট্রেন্ডে গা ভাসাচ্ছেন অধিকাংশ তরুণ-তরুণী?
তাদের জন্য কী-ই বা সাজিয়ে রেখেছে ফ্যাশন হাউজগুলো? আর কোন পোশাকের চাহিদা বেশি?
ট্রেন্ড আর তারুণ্যের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় থাকলেও আশানুরূপ গ্রাহকের দেখা মিলছে না বলে দাবি করছে ফ্যাশন হাউজগুলো।
এবারের ঈদে তরুণীদের পছন্দের তালিকায় ইন্ডিয়ান পোশাকের আধিক্য বেশি। এর মধ্যে রয়েছে গাউন, শারারাহ, গারারাহ অন পিস, টু পিস, থ্রি পিস, স্কার্ট , কুর্তি, মুনলাইট, টপস আর লেহেঙ্গা। এছাড়াও ওয়েস্টার্ন শার্ট, পালাজ্জো ও জিনস পোশাকও রয়েছে উঠতি মেয়েদের চাহিদায়। ফতুয়া, ফ্রক, সেলোয়ার কমিজ হালকা ডিজাইনের শাড়িও রয়েছে নারীদের পছন্দের তালিকায়।
এবারের ঈদে কিছুটা ভ্যাপসা গরম ও বৃষ্টিস্নাত আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে সুতি কাপড়কেই বেছে নিচ্ছেন অধিকাংশ ক্রেতারা। এছাড়াও এবার লিলেন, জর্জেট, শিফন, ইউনি কটন ও এন্ডি কটনের চাহিদা বেশি।
এছাড়াও বাজারে তরুণদের চাহিদায় রয়েছে- শার্ট, টিশার্ট, প্যান্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, বিভিন্ন স্টাইলের পাজামা ছাড়াও কাবলি ও শেরওয়ানির দিকে ঝুঁকছেন অনেকেই।
নগরীর শিয়া মসজিদ মোড়ে টোকিও স্কয়ার শপিং মল, শ্যামলি কমপ্লেক্স, প্রিন্স প্লাজা, কৃষি মার্কেট, রাপা প্লাজা, বিপণিবিতান, লাইফস্টাইলসহ বিভিন্ন নামি-বেনামি ব্র্যান্ডের দোকানে অনেকটা ঝিমিয়েই চলছে বিকিকিনি।
গত দুই দিন বাজার ঘুরে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। তবে শপিং মল থেকে সাধারণ বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতার আধিক্য লক্ষ করা গেছে।
ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে তরুণ-তরুণীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিনেমার নামে নামকরণ করা কিছু পোশাকও। এছাড়াও পোশাকের স্টাইলেও এসেছে কিছুটা ভিন্নতা।
এ বিষয়ে টোকিও স্কয়ার শপিং মল বি-মেইড নামের একটি ফ্যাশন হাউজের সত্ত্বাধিকারী নাইম চৌধুরী দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন:
শিশু, মধ্যবয়স্ক ও বয়স্করা সুতি কাপড়ের দিকেই ঝুঁকছেন। একটু ঢিলেঢালা পোশাকই পছন্দ করছেন নারীরা। তবে বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী ট্রেন্ড আর ভাইরাল পোশাকের দিকেই এগুচ্ছে।
তিনি জানান, তরুণীরা শারারাহ, গাউন, অন পিস, থ্রি পিস এগুলোই নিচ্ছে। তবে চাহিদার উপরের দিকে রয়েছে স্কার্ট আর টপস। গাউন ও শারারাহগুলো বিক্রি হচ্ছে ৩৫০০ থেকে ৭০০০ টাকার মধ্যে। তরুণদের পছন্দে রয়েছে পুষ্পা শার্ট, পুষ্পা প্যান্ট ও পুষ্পা গেঞ্জি। এক একটি পুষ্পা শার্টের দাম পড়বে ৩ হাজার, পুষ্পা প্যান্ট মিলছে ৪ হাজার টাকায়। ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পুষ্পা গেঞ্জি।
এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, আসলে পুষ্পা কাপড় বলতে কিছুই নাই। আমরা চেকের শার্টগুলো পুষ্পা নামে বিক্রি করছি। যেগুলো পুষ্পা- দ্যা রাইজ সিনেমার জন্য তরুণদের মধ্যে এ নামের পোশাকগুলো ক্রেইজ তৈরি করেছে।
আরেক দোকান নাহারের ম্যানেজার বলেন, তরুণীরা সবচেয়ে বেশি কিনছে শারারাহ আর গাউন। শারারাহ মূলত এক ধরনের থ্রি-পিস। এর নিচে স্কার্ট আর উপরে পার্টে জামা রয়েছে। এছাড়াও সঙ্গে আছে কটি আর ওড়না। সব মিলিয়ে দাম পড়বে ৭৫০০ থেকে ৮৫০০ টাকা ।এছাড়াও এবার মুনলাইট নামে আরেকটি জামার চাহিদা রয়েছে বেশ। এ কাপড়টি বেশ চকচকে হওয়ায় এর নাম দেয়া হয়েছে মুনলাইট। এটি এক পার্টের এক জামা। এর দাম ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও লেহেঙ্গার চাহিদা দেখা যাচ্ছে। যেগুলো প্রায় ৫ হাজার থেকে ৮ হাজারের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন মডেলের কুর্তি জামাগুলোও পছন্দ করছেন তরুণীরা। অল্প বয়সী মেয়েরা টপস আর গারারাহ শারারাহই বেশি কিনছে।
কুইন্স নামে আরেকটি শো রুমের ম্যানেজার অলিব রহমান বলেন, বাজারে পুষ্পা জামার চাহিদা ভালো। নতুন মুভি হিট হয়েছে তাই এই নামে জামা খুঁজছে সবাই। ইয়াং জেনারেশনের মাঝে এটা বেশ ভালো চলছে। পুষ্পা জামাগুলোর মধ্যে স্পেশালি একটা বা দুইটা ডিজাইন থাকে। এখন একটা চলছে আরেকটা এক দুই দিনের মধ্যেই আসবে। এগুলো বিক্রি হচ্ছে ৬-৮ হাজার টাকায়। গাউন কুর্তি, অন পিসের চাহিদাও ভালো।
তিনি আরও জানান, পুষ্পা ছাড়াও মেয়েদের শার্ট ও ওয়েস্টার্ন ড্রেসও চলছে। তবে ইন্ডিয়ান ড্রেসের চাহিদাই বেশি- এর মধ্যে লেহেঙ্গা, শারারাহ, গারারাহ, কামিজ, টপস, অন পিস, টু পিস বেশি চলছে।
টোকিও স্কয়ারে ভাইয়ের মেয়েকে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন হাউজ ওয়াইফ মুনিরা বেগম।
ঈদে তিনি কী কী কিনেছেন জানতে চাওয়া হলে বলেন, এবারের ঈদে কিছুটা ভ্যাপসা গরম ও বৃষ্টি দুটো সময়ের জন্যই আদর্শ হিসেবে সুতি কাপড়কেই গুরুত্ব দিচ্ছি। গরমের সময় আরামের জন্য টপস, সুতি জামা আর ঢিলেঢালা জামা কিনব।
অনেকটা আফসোস নিয়েই ভিন্ন সুরে কথা বলেন মারিয়া ফ্যাশনের দায়িত্বে থাকা তুহিন। তিনি বলেন, আমাদের ১৪ বছরের ব্যবসা। এত বাজে ব্যবসার এর আগে কখনও হয়নি। দুই বছর করোনার কারণে মন্দ সময় গেলেও দিনের ৪ ঘণ্টায় ২০-২৫ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি করছি। আর এখন দিনশেষে টেনেটুনে ১২-১৫ হাজারও হয় না। দোকানের ভাড়া, কর্মী বেতন দিয়ে দিনশেষে ব্যবসায় লস। এছাড়াও ভ্যাট অফিসের চাপ আছে। বিক্রি হোক বা না হোক ভ্যাট দিতেই হবে।
''এখন মনে করেন আপনার কাছে এই ছোট দোকানে ভ্যাট চায় আপনি কিভাবে দিবেন? মার্কেট আরও খারাপ করে দিচ্ছে।'' অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বলেন এ ব্যবসায়ী।
কোন ধরনের কাপড়ের চাহিদা বেশি জানতে চাইলে এ বিক্রেতা বলেন, মার্কেটে ক্রেতা কম। ক্রেতা না আসলে চাহিদা বুঝব কীভাবে। যখন দোকানে ২০-২৫ জন আসবে তখন জামা-কাপড়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা সেসময় বোঝা যাবে।
তিনি আরও বলেন, আমার দোকানে সব জামাই ইন্ডিয়ান। পুষ্পা, শারারাহ, গারারাহ এইগুলা পুরাতন মডেল- আমরা তুলি নাই। ২/৪ বছর আগে বিক্রি করছি। এইগুলা এখন অনলাইনে লেটেস্ট। গত লকডাউনের আগে গারারাহ বিক্রি করে শেষ করেছি। মানুষ মূলত ইন্ডিয়ান পোশাক ফলো করে। তবে ৮-১৬ হাজার টাকায় গাউন টাইপের জামাটা একটু বিক্রি হচ্ছে। জিন্স, টপস এগুলোও ভালোই চলছে। বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকায়।
ওয়েস্টরি নামের আরেক ফ্যাশন হাউজের ম্যানেজার ফয়সাল হোসেন বলেন, দোকানে ক্রেতা নাই। চাপ নাই। আশা অনুযায়ী বিক্রি নাই।
ঐ দোকানের এক কর্মী বলেন, বাইরের শার্টগুলো ১৮০০-২০০০ এর মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব সুতি কাপড়ের শার্টগুলো ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও ইন্ডিয়া থেকেই এক্সপোর্ট করে আনা 'সুলতান'র পাঞ্জাবিগুলো ভালো চলছে। এগুলো ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এগুলো মূলত ইউনি কটন, পিওর কটন, এন্ডি কটন কাপড়ের। এছাড়াও দেশি পাঞ্জাবিগুলো ১৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও মেয়েদের অনপিস গাউন ভালো বিক্রি হচ্ছে।
ট্রেন্ডের পোশাক নিয়ে তিনি বলেন, ''আমি যদি বলি এটা পুষ্পা পাঞ্জাবি তাইলেই এটা পুষ্পা পাঞ্জাবি হয়ে যাবে। আসলে পুষ্পা কাপড় বলতে কিছু নাই। যে যেভাবে পারে বলে বিক্রি করছে।''
স্বামী সন্তানের জন্য পোশাক কিনতে এসেছেন উম্মুল খায়ের নামের এক গৃহিণী। তিনি বলেন, কাপড়ের দাম মোটামুটি রেঞ্জের মধ্যেই আছে। এখন তো অনেক শারারাহ, গারারাহ চলছে। আমিও সাড়ে ৫ হাজার টাকায় একটা নিয়েছি। ট্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। ছেলের জন্য পাঞ্জাবি, শার্ট, টি-শার্ট আর ফতুয়া কিনলাম। হাজবেন্ডের জন্য নরমাল শার্ট, গেঞ্জি আর পাঞ্জাবি নিয়েছি। কেনার ক্ষেত্রে সুতি কাপড়কেই প্রাধান্য দিয়েছি।
নগরীর প্রিন্স প্লাজার সামনে দ্য বিজনেস পোস্টের সঙ্গে কথা হয় ফ্যাশন ডিজাইনার ও বাজার বিশ্লেষক লাইফস্টাইল বুটিক হাউজের সত্ত্বাধিকারী ও নারী উদ্যোক্তা রহমান।
তিনি বলেন, গত দুই বছরে করোনার বড় ধাক্কা গেছে। তারপরও ১৫-১৬ রোজায় যে ব্যবসা হওয়ার কথা। তার কিছুই নেই। বাজারে ক্রেতা নেই। গতবছরও যখন করোনা ছিল তখনও প্রতিদিন ২০ হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয়েছে। আর এখন পাঁচ হাজারই বিক্রি করতেই কষ্ট হচ্ছে।
দাম বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে এ ব্যবসায়ী বলেন, প্রত্যেকটা জিনিসের দাম যদি বাড়ে তাহলে কাপড়ের কেন নয়। কাপড়ের দাম বাড়ানো হোক। এটা না হলে এবারে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারবে না।
ব্লক-বাটিক নিয়ে তিনি বলেন, ব্লক-বাটিক দেশীয় পোশাক। ৫ বছর আগে এগুলো বন্ধ হয়ে গেছিল। ইন্ডিয়ানরা যখন তুলে ধরল তখন এগুলোর ডিমান্ড বেড়ে গেল। ইন্ডিয়া থেকে আসা শুরু হলো। শারারাহ-গারারাহ আবার দেশে তৈরি করা শুরু করল। দেখা যায় আগে যেসব ব্লক-বাটিক ১৫০০ থেকে ১৮০০'র মধ্যে কিনেছি এখন এগুলো প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি।
''এই যে দেখেন না সালমান খান কি পড়ল অই ট্রেন্ডের মতো ছেলেরা শার্ট-প্যান্ট পরে। ঠিক তেমনি ইন্ডিয়ান নায়িকারা কি পরল। এটা দেখেই তো স্টাইল ঠিক হয়।''
তবে দেশে এসব জামার উৎপাদন বাড়লে বাইরে থেকে আমদানি কম হবে। দেশীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।