প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

অনিয়মিত ঋণ ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা

ওপেক্স বন্ধে দুশ্চিন্তায় দেশি-বিদেশি ব্যাংক

২৭ অক্টোবর ২০২১ ১৩:০৩:২৮ | আপডেট: ৩ years আগে
ওপেক্স বন্ধে দুশ্চিন্তায় দেশি-বিদেশি ব্যাংক

মেহেদী হাসান

সম্প্রতি ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপ তাদের নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ায় গ্রুপটির কাছে পাওনা বিশাল ঋণ আদায় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে দেশি-বিদেশি এক ডজনেরও বেশি ব্যাংক।

এশিয়ার বৃহত্তম গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল শিল্প গ্রুপটির কাছে ব্যাংকগুলোর অনিয়মিত ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এখন এ বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনরুদ্ধার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ব্যাংকগুলো।

'বিশাল আর্থিক ক্ষতি'- এ কারণ দেখিয়ে গত ১৯ অক্টোবর কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেয় টেক্সটাইল খাতের বড় এ প্রতিষ্ঠানটি।

গ্রুপটির ঋণ রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও বিদেশি ব্যাংকের কাছে।

ব্যাংকারদের মতে, করোনা মহামারির মধ্যে কিছু ঋণ বিলম্বিত এবং পুনঃতফসিল হয়েছে। ওপেক্স গ্রুপ অব কোম্পানির ঋণের কিস্তি এখন অনিয়মিত বলেও জানান তারা।

এসব ব্যাংকের অর্ধ ডজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, এত বড় পোশাক শিল্প তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া খুবই হতবাকের বিষয়।

পোশাক খাতে এশিয়ার বড় এ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংকিং সেক্টরে বিপুল পরিমাণ ঋণসহ নানা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটি ১৯ অক্টোবর তাদের নারায়ণগঞ্জের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

গত ১৮ অক্টোবর গ্রুপটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) বানিজ আলী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে স্থায়ীভাবে কারখানাগুলো বন্ধের ঘোষণা আসে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রতিনিধি ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে মজুরি ও বকেয়া পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান সিনহা ১৯৮৪ সাল থেকে ওপেক্স গ্রুপের অধীনে দুই ডজনেরও বেশি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গুণগত মানের পণ্যের কারণে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করে।

গ্রুপটির গার্মেন্টস বিভাগের পাশাপাশি শুকনো ও ভেজা প্রক্রিয়াকরণ সুবিধা, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ এবং লম্বা সেটআপ, ডেনিম এবং আনুষাঙ্গিক কারখানা ছিল।

চলতি বছরের জুন শেষে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের কাছে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫০ কোটি টাকায়।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি এবং সিইও খোন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, আর্থিক সমস্যায় পড়ার কারণে সবচেয়ে বড় ও পুরানো পোশাক শিল্পটির ব্যবসায়িক ঋণ এখন অনিয়মিত।

একইভাবে চলতি বছরের জুন শেষে পূবালী ব্যাংকে গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সফিউল আলম খান চৌধুরী দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটির ঋণ এখন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, আমরা গ্রুপটির ঋণ নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন, তবে পূবালী ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে শক্তিশালী জামানত রয়েছে।

সিটি ব্যাংকে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের বকেয়া ঋণ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ওপেক্স ভাল ও স্বনামধন্য শিল্প গ্রুপ ছিল, কিন্তু এখন এর সমস্ত ঋণ অনিয়মিত হয়ে গেছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কাছে গ্রুপটির বকেয়া ঋণের পরিমাণ ৭০ কোটি টাকা।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, জনাব সিনহা ভালো শিল্পপতি, কিন্তু এখন তিনি নিজের কারণে সমস্যায় পড়েছেন।

তিনি বলেন, সিনহা কাউকে প্রতিনিধি না করেই তার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিজেই পরিচালনা করছিলেন, যা গ্রুপটির আজকের এ দশার কারণ হতে পারে। তাদের অধিকাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

ঢাকা ব্যাংকের কাছে ওপেক্স গ্রুপের বকেয়া ঋণ জুন পর্যন্ত প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এমরানুল হক বলেন, আমরা গ্রুপের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সম্পূর্ণ হতবাক, এখন প্রতিষ্ঠানটির ঋণ পরিশোধ হচ্ছে খুবই ধীরগতিতে।

তিনি বলেন, গ্রুপের বিনিয়োগের বিপরীতে নগদ প্রবাহ নেতিবাচক ছিল, যা কোম্পানির আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

জুন পর্যন্ত এবি ব্যাংকের ৭০ কোটি টাকা, মেঘনা ব্যাংকের ৪০ কোটি টাকা এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের ১২ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের কাছে।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ওপেক্স গ্রুপ থেকে বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ পুনরুদ্ধারের বিষয়ে দেশীয় ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এখনও কোনো অনুরোধ আসেনি।

তবে তারা বলেছে, প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবসায়িক গ্রুপের কাছ থেকে অর্থ পুনরুদ্ধারে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ওপেক্সের এক ডজনেরও বেশি ব্যাংকের কাছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি অনাদায়ী ঋণ রয়েছে বলে আমাদের কাছে অনুমিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক খুব গভীরভাবে এটি পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানান তিনি।

বীমা খাতের সূত্রগুলো বিজনেস পোস্ট’কে জানিয়েছে, বেশ কয়েকটি বীমা কোম্পানিও গ্রুপটি থেকে তাদের অবৈতনিক বীমার অর্থ আদায় করতে সমস্যায় পড়েছে। কারণ, কিছু বীমাকারী সরল বিশ্বাসে ওপেক্সের পক্ষে বীমার অর্থ ক্লিয়ার করেছে। গ্রুপটি দীর্ঘদিন ধরেই ভালো গ্রাহক ছিল।

রাষ্ট্র পরিচালিত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, প্রায় ৪৫ হাজার কর্মচারীর পোশাক শিল্প কারখানাটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

এত বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিকে এভাবে শেষ হতে দেয়া উচিত নয় উল্লেখ করে এ ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, গ্রুপটির এখন সহযোগিতা প্রয়োজন; চুক্তি এবং জোটের নির্দেশনা মেনে চলার সময় এটি আর্থিক সমস্যায় পড়ে।

এশিয়ার বৃহত্তম এ পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংককে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান শামস-উল ইসলাম।

সমস্যা হলো অন্যরা এ ঘটনা ঘিরে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করবে বলেও মনে করেন এ ব্যাংকার।

শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দিন দিন ব্যাংকগুলোর প্রতি কোম্পানির দায় বাড়ছে। একইসময়ে এর পরিচালন ব্যয় এবং শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া- এসব পরিস্থিতিই কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য করেছে।

একুশ শতকের শুরুতে গ্রুপটি ৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে এবং প্রায় ৪৫ হাজার লোককে নিয়োগ দেয়। প্রতিষ্ঠানটির এমন স্বর্ণযুগও ছিল, যখন অর্ডার দেয়ার জন্য ক্রেতাদের লাইনে থাকতে হতো। গ্রুপটির যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং হংকংয়ে তিনটি অফিসও ছিল।

ওপেক্স গ্রুপ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে।

এর শীর্ষ ক্রেতাদের মধ্যে ছিল, লেভিস, ভিএফ, আমেরিকান ঈগল, নাউটিকা, জেসিপেনি, টার্গেট, পিভিএইচ, জিএপি, হেনেস, হেগারস, পেরি ইলিস, সিয়ারস, অক্সফোর্ড, এইন (জাপান), এইচঅ্যান্ডএম, ওভিএস, ম্যাসি, নেক্সট, ওসখোস।

পোশাক শিল্পটিতে ১৮ হাজারের বেশি সেলাই মেশিন ৩০০টি উৎপাদন লাইনে সংযোজন করা হয়েছিল। এটির বিশেষায়িত জ্যাকেট সোয়েটার উৎপাদন ইউনিটও ছিল।

সিনহা গ্রুপের কারখানাগুলোর প্রতিদিন ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি পোশাক উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল।