প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

ওপেক্স সিনহা’র হিরো থেকে জিরোর নেপথ্যে

২৪ অক্টোবর ২০২১ ১৬:০২:২০ | আপডেট: ৩ years আগে
ওপেক্স সিনহা’র হিরো থেকে জিরোর নেপথ্যে

আরিফুর রহমান তুহিন

উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অদক্ষতা আর অব্যবস্থাপনা, সেইসাথে করোনা মহামারির বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে এক সময়ের এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম গার্মেন্ট পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের সবগুলো কারখানা। 

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ওপেক্স সিনহা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর সফলতা ছিল অনন্য উচ্চতায়। যার বার্ষিক আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। আর কারখানাগুলোতে কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫ হাজার।

প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সময়ও ছিল, যখন অর্ডার দেয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন ক্রেতারা। স্বর্ণ যুগ ফেলে আসা এ গ্রুপটির বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও হংকংয়ে তিনটি লিয়াজোঁ অফিসও ছিল।

কিন্তু ২০ বছরের মাথায় গ্রুপটি গত ১৯ অক্টোবর তাদের কারখানাগুলো বন্ধ ঘোষণা করে।

সূত্র জানায়, গত বছর করোনা মহামারি শুরু হলে ওপেক্স গ্রুপ বেশ কয়েকবার তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ১ অক্টোবর সব কারখানা ফের বন্ধ ঘোষণা করে গ্রুপটি, তবে চালু রাখে টেক্সটাইল বিভাগ। সূত্র বলছে, কারখানাগুলো আবারও চালু হবে কিনা তা অনিশ্চিত।

ওপেক্স সিনহার মহাব্যবস্থাপক (পলিসি) মো: আবু জাফর দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, তারা শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের চেষ্টা করছেন। ১ অক্টোবর গ্রুপটি শ্রমিকদের দুই মাসের বকেয়া পরিশোধ করেছে।

কিন্তু শ্রমিকরা জানান, বাকি পাওনাদি পাবেন কি না, তা নিয়ে তারা এখন সন্দিহান।

কর্মীদেরই একজন মো. শাহজাহান। তিনি বলেন, আমি প্রায় ১৬ বছর আগে কারখানাটিতে যোগ দেই। যখন কারখানাটি ওপেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান সিনহার নেতৃত্বে সোনালী যুগ পার করছিল।

ঢাকা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের কাঁচপুরে অবস্থিত ওই কারখানা এলাকায় গত সপ্তাহে যান বিজনেস পোস্ট-এর প্রতিবেদক। তখন মো. শাহজাহান প্রতিবেদককে বলেন, আমি এখনও তাদের কর্মচারী। কিন্তু, গত তিন মাসে আমি কোনো বেতন পাইনি। এখন, আমি জীবন বাঁচাতে রিকশা চালাই।

কারখানায় নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, টেক্সটাইল বিভাগে এখন প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।

এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, প্রায় ১ দশক ধরে শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। করোনা মহামারি চলাকালে এ সমস্যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় কারখানাটি দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। কর্তৃপক্ষ মজুরি দিতে পারেনি, এতে শ্রমিকরা বিক্ষোভও করে।

গত কোরবানির ঈদের পর থেকে শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতনের জন্য কয়েক দফা আন্দোলন করেছে। চলতি অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় শ্রম অধিদপ্তরের সামনে কয়েক বার তারা জড়ো হন। সরকারি ওই সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের পর কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের জন্য ১৭ অক্টোবর দিন ঠিক করেছিল।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শ্রমিকদের পাওনা ও গ্র্যাচুইটি দিতে কোম্পানির প্রায় ৪৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। কোম্পানিটি এখন তার জমি এবং অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার চেষ্টা করছে।

রুপা গ্রুপের এমডি শহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, এটা কষ্টদায়ক যে, ওপেক্স গ্রুপের কর্মীদের বেতনের জন্য বিক্ষোভ করতে হয়। অথচ ১ দশকের আগেও তিনি (আনিসুর রহমান সিনহা) অনেক কারখানার মালিককে সময়মতো বেতন দিতে সহযোগিতা করেছেন।

স্বপ্নের যাত্রা

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সিনহা ১৯৮৪ সাল থেকে ওপেক্স গ্রুপের অধীনে দুই ডজনেরও বেশি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং গুণগত মানের কারণে বিশ্বব্যাপী সুনামও কুড়িয়েছেন।

ওপেক্স গ্রুপের গার্মেন্টস বিভাগ, বটম ফ্যাক্টরি, শার্ট ফ্যাক্টরি, নিট গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, জ্যাকেট ফ্যাক্টরি এবং সোয়েটার ফ্যাক্টরি, ড্রাই অ্যান্ড ওয়েট প্রসেসিং সুবিধা, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এবং ভার্টিক্যাল সেটআপ, ডেনিম ভিলেজ এবং অ্যাকসেসরিজ কারখানা ছিল।

৪৩ একর জমিতে কারখানাগুলো নির্মাণ করা হয় এবং শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার।

রুপা গ্রুপের এমডি শহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, নিজের মতো অনেকের জন্য সিনহা ছিলেন অনুপ্রেরণা। অথচ এখন তিনি হতাশার উদাহরণ।

ওপেক্স গ্রুপ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামি ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের কাছ থেকে পণ্য নিত। শীর্ষ ক্রেতাদের মধ্যে ছিল, লেভিস, ভিএফ, আমেরিকান ঈগল, নাউটিকা, জেসিপেনি, টার্গেট, পিভিএইচ, জিএপি, হেনেস, হেগারস, পেরি ইলিস, সিয়ারস, অক্সফোর্ড, এইন (জাপান), এইচঅ্যান্ডএম, ওভিএস, ম্যাসি, নেক্সট, ওসখোস।

এ গ্রুপের ১৮ হাজারের বেশি সেলাই মেশিন ৩০০ উৎপাদন লাইনে যুক্ত করা হয় এবং বিশেষ জ্যাকেট সোয়েটার উৎপাদন ইউনিট ছিল। ওপেক্স গ্রুপের মতে, এটি প্রতিদিন ২ লাখ ২০ হাজার পিস গার্মেন্টস পণ্য তৈরি করতে পারতো।

কোম্পানির প্রায় ২০০টি  উৎপাদন লাইন প্রতিদিন ১ লাখ ২৫ হাজার আংশিক পোশাক তৈরি করে। ওপেক্সের ১৬টি ডেডিকেটেড বিশেষায়িত ডেনিম উৎপাদন লাইন ছিল, যা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারাইজড সেলাই এবং ফিনিশিং রেঞ্জ মেশিনে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ হাজার পোশাক উৎপাদনে সক্ষম।

কোম্পানিটির ৫৯টি ডেডিকেটেড শার্ট লাইন ছিল যা দৈনিক ৬০ হাজার পিস সাধারণ, খেলাধুলা এবং আনুষ্ঠানিক শার্ট তৈরি করে। কাঁচপুরে আরও ১২ লাইনের জ্যাকেট কারখানা এবং এইপিজেডে ১০ লাইনের কারখানা প্রতি মাসে ৩ লাখ পিস উৎপাদনের মাসিক ক্ষমতা সম্পন্ন। কোম্পানিটির প্রতি মাসে ২ লাখ ৫০ হাজার পিস সোয়েটার, দুই মিলিয়ন আংশিক ডেনিম বটম এবং জ্যাকেট উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল।

রানা প্লাজা ও করোনা’র দুঃস্বপ্ন

ওপেক্স গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, রানা প্লাজা ধসের পর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স বাংলাদেশে এসে কারখানা পরিদর্শন শুরু করে। যখন তারা ওপেক্সের কারখানা পরিদর্শন করে, তখন কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বেশকিছু সুপারিশ করে।

রানা প্লাজা ধসের আগে, এ কোম্পানির কয়েকটি ব্যাংক ঋণ ছিল, কিন্তু অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স সামনে আসার পর ওপেক্সের ব্যাংক দায় বেড়ে যায়, সিনহাকে খেলাপিতে পরিণত করে। এ কারণেই তিনি এ কোম্পানিটি বিক্রি করতে পারেন নি; যদিও রিলায়েন্স গ্রুপ, ভারতসহ দেশ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী ছিল।

ওপেক্সের এক কর্মকর্তা বলেন, তারা অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের সুপারিশ অনুযায়ী নিরাপত্তার মান উন্নত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। ওপেক্স গ্রুপের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা বিনিয়োগ করতে বাধ্য ছিলাম। কারণ, ক্রেতারা আমাদের অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের সুপারিশ অনুসরণ করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন।

বিকেএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর আহমেদ দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের প্রস্তাবিত মান রক্ষায় ওপেক্স এক বিলিয়ন টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু একই সময়ে ক্রেতারা নতুন অর্ডার দেয়া বন্ধ করে কোম্পানিটিকে বাধার মুখে ফেলে।

রুপা গ্রুপের সহিদুল বলেন, ক্রেতা জোট ওপেক্স গ্রুপে কিছু নিরাপত্তা সমস্যা খুঁজে পেয়ে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। এরপর বিপুল পরিমাণ কাজের অর্ডারও বাতিল করে। এটি-ই সিনহা ও ওপেক্সের ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ বলেন, তিনি মনে করেন, ক্রেতারা সিনহার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন। ক্রেতারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় তার লোকসান বেড়েছে।

অতিরিক্ত সক্ষমতা, অব্যবস্থাপনা, অনভিজ্ঞতা

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান ওপেক্সের এ দশার অন্যতম কারণ হিসেবে অতিরিক্ত সক্ষমতাকে চিহ্নিত করেছেন।

তিনি বলেন, আমি মনে করি এ গ্রুপের অতিরিক্ত সক্ষমতা ছিল যা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ যখন বাংলাদেশে আঘাত হানে তখন ওপেক্স অবশেষে সেই বিরূপ প্রভাব আঁচ করে । তিনি বিজিএমইএ সদস্যদের অতিরিক্ত সক্ষমতার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন। এটি টেকসই নয়।

সিনহার পরিচিত একজন বলেন, তিনি কাউকে ভালোভাবে বিশ্বাস করতেন না।

তিনি বলেন, সিনহা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সিনহা কিছু অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করেছেন। তার ব্যাংকে দায় বাড়লেও তিনি কর্ণপাত করেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যাংকগুলো তাকে সহযোগিতা বন্ধ করে দিলে তার অবস্থা কতটা খারাপ হয়, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

ওই ব্যক্তি জানান, তার মধ্য ও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মচারীদের অদক্ষতা এবং দুর্নীতি গ্রুপের পতনের সবচেয়ে বড় কারণ।

বিজিএমইএর প্রাক্তন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ বলেন, গ্রুপটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে এবং এ অবস্থার উত্তরণে খুবই কঠিন হবে।

তিনি বলেন, আমরা সিনহাকে স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে জানতাম। সিনহার সহযোগিতায় অনেক নতুন উদ্যোক্তা গার্মেন্টস মালিক হয়েছেন। কিন্তু এখন সে সব হারিয়েছেন। তিনি তার কর্মীদের সময়মতো বেতন দিতে পারছেন না, সমস্ত গার্মেন্টস ইউনিট এখন বন্ধ এবং তার বিশাল ব্যাংক ঋণও রয়েছে।

ফয়সাল সামাদ জানান, অক্টোবরের শুরুতে তিনি সিনহার সঙ্গে দেখা করেছেন, সে সময় সিনহা বেশ হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি ব্যবসা চালিয়ে যাবেন কি না- তাও তখন নিশ্চিত করতে পারেন নি।

আরেক গার্মেন্টস নেতা বলেন, সিনহা কোন পরিকল্পনা ছাড়াই তার ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছেন। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে শীর্ষ থেকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।

ওপেক্সের উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি ছিল এবং এর চাহিদা মেটাতে তাকে মাঝে মধ্যেই উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য রপ্তানি করতে হতো। সিনহা ক্রেতাদের পছন্দের ওপর অনেক নির্ভরশীল ছিলেন বলেও জানান ওই গার্মেন্টস মালিক নেতা।