প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

পোশাক শিল্পে সম্ভাবনা-২০২৩

কম উৎপাদন ব্যয়ই হবে প্রধান অস্ত্র

ইব্রাহিম হোসেন অভি
১৫ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:৫২:২১ | আপডেট: ২ years আগে
কম উৎপাদন ব্যয়ই হবে প্রধান অস্ত্র

২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী পোশাক খাত আরও সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। যার কারণ হিসেবে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সরবরাহে বিঘ্নতাসহ অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ বিশ্বের নামিদামি পোশাক কোম্পানিগুলো স্বল্প মূল্যের কারণে এখান থেকে উৎপাদন অব্যাহত থাকবে।

এ বিষয়ে গত সপ্তাহে ‘বিজনেস অফ ফ্যাশন ম্যাককিনসে স্টেট অফ ফ্যাশন ২০২৩’ নামে এক জরিপ প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জন্য বাংলাদেশ থেকে পোশাকের আমদানির চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন বিশ্বের ক্রেতারা। এছাড়া বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মতো স্বল্প শ্রমের দেশে পোশাক উৎপাদন চালিয়ে যাবে উৎপাদনকারী।

এক প্রশ্নের জবাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এমএএস হোল্ডিংস গ্রুপের প্রধান নির্বাহী সুরেন ফার্নান্দো বলেছেন, ‘কয়েক বছর আগে আমাদের পণ্য সাধারণত শ্রীলঙ্কায় সরবরাহ হতো। কিন্তু এখন আমাদের উৎপাদন বাড়ছে। সেই সাথে বিদেশি ক্রেতাদেরও আগ্রহ বাড়ছে। আমাদের সবচেয়ে বড় উৎপাদনের কেন্দ্র শ্রীলঙ্কা হলেও এখন দেশেও উল্লেখযোগ্য হারে চাহিদা রয়েছে।’

জরিপে প্রায় ৬৫ শতাংশ ফ্যাশন এক্সিকিউটিভরা জানিয়েছেন, সরবরাহ চেইনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নিকটবর্তী হওয়ার কথা বিবেচনা করছেন। ফলে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলার এ সময়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক এবং এশিয়ান দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে এ খাতে এগিয়ে যাচ্ছে।

২০২৩ সালে পোশাক খাতের অবস্থা

জরিপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পোশাক শিল্পের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে জানিয়েছেন প্রায় ৫৬ শতাংশ ফ্যাশন এক্সিকিউটিভ। আর ২৮ শতাংশ মতামত দিয়েছেন, এতে কোন পরিবর্তন হবে না। এখন যে অবস্থায় আছে আগামী বছরও এ ভাবেই কেটে যাবে। তবে এ খাতটি আগামী বছরে আরও ভাল করবে বলে জানিয়েছেন ১৬ শতাংশ ফ্যাশন এক্সিকিউটিভ।

মার্কিন বাজারে অবিলাসী পোশাক খুচরা বিক্রয়ে ১ থেকে ৬ শতাংশ এবং চীনের বাজারে ২ থেকে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে ইউরোপের বাজারে চলতি বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে ১ থেকে ৪ শতাংশ বিক্রয় কমে যাবে। তবে বিলাসবহুল পোশাক বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে। এই ধরনের পোশাক ইউরোপীয় বাজারে খুচরা বিক্রয় ৩ থেকে 8 শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৫ থেকে ১০ শতাংশ এবং চীনা বাজারে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে জারিপে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং চলমান করোনা মহামারি থেকেও বেশি সুরক্ষিত যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশে ২০২২ এর তুলনায় ২০২৩ সালে পোশাক খাতে আরও বেশি আশার আলো দেখছেন প্রায় ৬১ শতাংশ ফ্যাশন এক্সিকিউটিভ। তবে ভিন্ন চিত্র ইউরোপীয় এবং এশিয়া অঞ্চলে। যথাক্রমে ৬৪ শতাংশ এবং ৫৩ শতাংশ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

বাংলাদেশের জন্য একক বৃহত্তম রপ্তানি কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র। এ বাজারের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ইঙ্গিত ইউরোপীয় অঞ্চলের নেতিবাচক প্রভাবকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘মার্কিন বাজারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ। কারণ সেখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো। যেহেতু বাংলাদেশের মধ্য-পরিসর এবং মৌলিক পণ্য তৈরীর সক্ষমতা রয়েছে। তাই আমরা ২০২৩ সালে বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে আরও বেশি বাজার দখল করতে সক্ষম হব।’

তিনি বলেন, ‘চীন বাজারের শেয়ার হারাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। গত এক দশকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ফলে এটি বৈশ্বিক বাজার দখলে নিতে দেশকে আরও সাহায্য করেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলি শামীম এহসান বলেন, ‘আমরা ইউরোপের বাজারে প্রায় ২০ শতাংশ দরপতন আশা করেছিলাম। তবে ৪ থেকে ৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরণে ক্ষতি হবে না। যেহেতু তারা এখান থেকে কেনাকাটা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে আমাদের খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্য এবং ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। পাশাপাশি রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সরকারের নীতিগত সহায়তা অব্যাহত রাখা উচিত।

২০২২ সালের জানুয়ারি-আগস্ট মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫৩.৫৪ শতাংশ বেড়ে ৬.৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। এ নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি রেকর্ড ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ১০.২৬ শতাংশ বেড়ে ৬.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। যা মোট পোশাক রপ্তানির ৫৯ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে বাংলাদেশ পোশাক খাতে ইইউ থেকে ২১.৪০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিলো।

আগামীর চ্যালেঞ্জ কি?

মুদ্রাস্ফীতি, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সরবরাহে বিঘ্নিত হওয়ায় পোশাক খাতে ঝুঁকি অব্যাহত রয়েছে। ফলে ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী এ শিল্পকে আরও খারাপ হতে পারে। জরিপে ফ্যাশন এক্সিকিউটিভরা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির কারণে পোশাক খাতের জন্য ঝুঁকি রয়েছে ৭৮ শতাংশ, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ৬৬ শতাংশ এবং ৫২ শতাংশ সরবরাহ চেইন ব্যাঘাতেকে দায়ী করেছে।

ইতিমধ্যে যে সংকটগুলো দেখা দিয়েছে, এর মধ্যে অর্থনৈতিক অস্থিরতার ফলে ৩১ শতাংশ, জ্বালানির দামে অস্থিরতায় ২৮ শতাংশ, ক্রমবর্ধমান সুদের হারে ১৭ শতাংশ, আর্থিক বাজারের অস্থিরতায় ১৫ শতাংশ, বাণিজ্য নীতি পরিবর্তনে ৭ শতাংশ এবং করোনা মহামারীর কারণে ৫ শতাংশকে দায়ী করা হয়েছে।

জরিপে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক মন্দা কতদিন স্থায়ী হতে পারে তা নিয়ে সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেন নাই ফ্যাশন এক্সিকিউটিভরা। তবে তারা একমত যে সামনের পরিস্থিতি পোশাক শিল্পের জন্য কঠিন হবে। মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং মার্জিন চাপ ছাড়াও ২০২৩ সালে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে ভোক্তা চাহিদা পরিবর্তন এবং আস্থা হ্রাস উল্লেখ করেছেন।

ব্র্যান্ডের পরিকল্পনা কি?

খরচের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব কমাতে সাহায্য করার জন্য, ৬০ শতাংশেরও বেশি ফ্যাশন এক্সিকিউটিভরা বলেছেন যে তারা সোর্সিং চুক্তিগুলোকে অপ্টিমাইজ বা পুনঃআলোচনা করার পরিকল্পনা করছেন। এছাড়াও অপ্রত্যাশিত ভোক্তা চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য নিকটবর্তী হওয়ার কথা বিবেচনা করছেন তারা।

তারা বলেছেন, বাজারে দখল বাড়ানোর জন্য সরবরাহকারীদের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বিবেচনা করে আরও দক্ষ সরবরাহ চেইন তৈরি করা হবে। যা দীর্ঘমেয়াদে সুবিধা বহন করবে। এ ক্ষেত্রে নিজস্ব ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্টের খরচ কমাতে এবং সোর্সিং চুক্তি সহজ করার জন্য প্রায় ৭৫ শতাংশ পণ্য এবং শৈলীর সংখ্যা কমিয়ে ইনভেন্টরি সহজ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ৬৫ শতাংশ ভাণ্ডারে মৌসুমী এবং মৌলিক আইটেমগুলোর মধ্যে ভারসাম্য সামঞ্জস্য করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এই হিসাবে, ফ্যাশন এক্সিকিউটিভরা প্রায় ৬০ শতাংশ তাদের ভাণ্ডারে কম দামের আইটেমগুলোর ভাগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেখানে ৮০ শতাংশ ফ্যাশন এক্সিকিউটিভরা আশা করেছেন, ২০২৩ সালে তাদের বিক্রয়ের ১০ শতাংশের বেশি প্রচার এবং ছাড়ের দ্বারা চালিত হবে।

বৃদ্ধির অগ্রাধিকার

২০২৩ সালে করোনা মহামারী চলাকালীন ক্যাজুয়ালাইজেশন প্রবণতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার আশা করছেন ফ্যাশন এক্সিকিউটিভরা। কারণ এর মধ্যে ক্রেতারা বাড়ি থেকে কাজ করতে চলে গেছে। ক্যাজুয়ালওয়্যার পরে স্পোর্টসওয়্যার এবং স্নিকার্স হল সর্বোচ্চ র‌্যাঙ্কিং বিভাগ যেখানে এক্সিকিউটিভরা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখতে পান।

এক্সিকিউটিভরা বিশ্বাস করেন, ভোক্তারা দিনের পর দিন নৈমিত্তিকভাবে পোশাক পরিধান করবে। এছাড়াও ২০২৩ সালে তাদের শীর্ষ তিনটি বৃদ্ধি বিভাগের একটি হবে, কারণ মহামারী চলাকালীন স্থগিত হওয়ার পরে বিবাহের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানগুলি বৃদ্ধি পায়।

যাইহোক, যদিও এক্সিকিউটিভরা বিশ্বাস করেন যে ভোক্তারা দিনের পর দিন নৈমিত্তিকভাবে পোশাক পরিধান করা চালিয়ে যাবে। এতে প্রায় ৪০ শতাংশ ফ্যাশন এক্সিকিউটিভরা আশা করছেন, ২০২৩ সালে তাদের শীর্ষ তিনটি যে উপলক্ষ পরিধান বৃদ্ধি বিভাগের একটি হবে, কারণ মহামারী চলাকালীন স্থগিত হওয়ার পরে বিবাহের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের আরএমজি রপ্তানির অবস্থা

২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর মাসে পোশাক রপ্তানি ১৫.৬১ শতাংশ বেড়ে ১৮.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। যা এক বছর আগে ১৫.৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। কিন্তু এর আগের অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি করে আয় ৩৫.৪৭ শতাংশ বেড়ে ৪২.৬১ বিলিয়ন মারর্কিন ডলর আয় হয়েছে। যা এর আগের বছরে ৩১.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।

৪২.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে নিটওয়্যার পণ্যগুলো ২৩.২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভ করেছে। যা গত অর্থবছরের ১৯.৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৩৬.৮৮ শতাংশ বেশি। একই সময় বোনা আইটেমগুলোতে ৩৩.৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে।