চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তালিকাভুক্ত ২৪টি লাভজনক কোম্পানি লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। যদিও বিগত অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিলো মাত্র ৮। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সেটি প্রায় ৩ গুণ বেড়ে ২৪ কোম্পানিতে দাঁড়িয়েছে।
এর কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং জ্বালানি সংকটকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।
এখন পর্যন্ত দেশের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত রয়েছে ৩৫৩টি কোম্পানি। এর মধ্যে ২৯৪টি কোম্পানি তাদের সর্বশেষ প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২২) আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে মুনাফা করেছে ২৩২টি কোম্পানি এবং লোকসান হয়েছে ৬২ কোম্পানির। বাকি ২৪টি নতুন কোম্পানি তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
এর মধ্যে প্রকৌশল খাতের কোম্পানি রয়েছে ৭টি। এছাড়াও বিদ্যুৎ, বস্ত্র, অর্থ, বীমা, রাসায়নিক, ট্যানারি এবং পর্যটন খাতের কোম্পানি রয়েছে।
কোম্পানিগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস থেকেই উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়তে শুরু করেছে। ডলারের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে।
লাভ থেকে লোকসানে যাওয়া কোম্পানিগুলো হলো- ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ, সিঙ্গারবিডি, এসিআই লিমিটেড, বারাকা পাওয়ার, বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার, অ্যাপেক্স ট্যানারি, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইফাদ অটোস, রানার অটোমোবাইলস, লিগ্যানসি ফুটওয়্যার, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামিক ফাইন্যান্স, প্রভাতি ইন্স্যুরেন্স, পেনিনসুলা চিটাগাং, গোল্ডেন সন, সাফকো স্পিনিং, বিডি থাই, ফার ইস্ট নিটিং, প্রাইম টেক্সটাইল, গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, রহিম টেক্সটাইলস এবং খান ব্রাদার্স পিপি বোনা ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ।
দেশের সবচেয়ে বড় ইলেকট্রনিক্স এবং অ্যাপ্লায়েন্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ। তারা চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৪৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
কোম্পানিটি বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দর বেড়েছে। সেই সাথে টাকার বিপরীতে ডলারের ক্রমবর্ধমান মূল্য বেড়েছে। ফলে চলতি বছরের শুরু থেকেই আমদানি ব্যয় বেশি ছিলো। এতে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ কারণে চলতি অর্থবছরের সদ্য সমাপ্ত প্রান্তিকেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ কোম্পানিটির নেট লাভ ছিলো ২৮১ কোটি টাকা।
চলমান অর্থনীতির ধকল এসিআই লিমিটেডের উপরেও পড়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক এ প্রতিষ্ঠানটি চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১৮ দশমিক ৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। অপরদিকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটি ৩০ দশমিক ১২ কোটি টাকা মুনাফা করেছিলো।
কোম্পানিটি বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অত্যাধিক অবমূল্যায়ন, কাঁচামালের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, মালবাহী পরিবহনের খরচ বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় তীব্রভাবে বেড়েছে। যা গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক থেকেই ক্রমান্বয়ে লোকসানের দিকে যাচ্ছে।
দেশের তালিকাভুক্ত আটটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির মধ্যে সাতটি কোম্পানি তাদের আয়ের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নথিভুক্ত করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শুধু ‘বারাকা পাওয়ার’ এবং ‘বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেড’ তাদের লোকসানের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে উল্লেখযোগ্য স্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা তৈরী হয়েছে। এ কারণে দেশের কোম্পানিগুলোর আয়ে ভাটা পড়ছে।
পেনিনসুলা চিটাগাং হোটেলের আয় গত অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৬৫ শতাংশ বেড়ে ৯ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা হয়েছে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির কারণে তাদের রাজস্ব কমেছে। গত বছরে কোম্পানিটির মুনাফা ৩ দশমিক ৬৯ কোটি টাকার তুলনায় ৩ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
দ্য পেনিনসুলার কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ নুরুল আজিম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘সেবার মান নিশ্চিত করতে আমাদের অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়। কিন্তু মার্কিন ডলারের দাম বেশি হওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। তবে গ্রাহকদের স্বার্থে আমরা সেবার মূল্য অপরিবর্তীত রেখেছি। ফলে আমাদের লোকসান গুণতে হচ্ছে।’
দেশের শীর্ষস্থানীয় বাইক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রানার অটোমোবাইলস চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক প্রকাশ করেছে। এ সময় কোম্পানিটি ৮ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা ক্ষতির কথা জানিয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ১০ দশমিক ৪ কোটি টাকার মুনাফা ছিলো।
কোম্পানিটির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার শানত দত্ত বলেন, টাকার অবমূল্যায়নের ফলে এ বছর কাঁচামালের দাম এক-পঞ্চমাংশের বেশি বেড়েছে। কোম্পানিগুলোকে সেই অনুযায়ী দাম বাড়াতে হয়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এ দাম বাড়ানো হয়েছে।