প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

টিকে থাকার লড়াইয়ে রাইড শেয়ারিং খাত

০১ নভেম্বর ২০২১ ১৬:১৫:৫১ | আপডেট: ৩ years আগে
টিকে থাকার লড়াইয়ে রাইড শেয়ারিং খাত

রিফাত ইসলাম

করোনা মহামারির মধ্যে টিকে থাকতে লড়াই করছে অ্যাপ-ভিত্তিক রাইডশেয়ারিং পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ চালকদের একটি অংশ কোম্পানিকে ভাড়ার কমিশন যেন না দিতে হয় সেজন্য তারা অ্যাপ ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছেন।

অন্যদিকে, অনেক ব্যবহারকারী অ্যাপ ব্যবহার না করেই সরাসরি চালকদের সাথে চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় যাতায়াত করছেন, যাতে করে অ্যাপে যে পরিমাণ ভাড়া আসে, তার চেয়ে কমে যাতায়াত করতে পারেন।

এ দু’টি কাজই সরকারি বিধি অনুযায়ী বেআইনি।

দেশে রাইড শেয়ারিং সেক্টরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ‘সহজ’ ইতোমধ্যেই তাদের সব রকম রাইড শেয়ারিং পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে। অপর কোম্পানি ‘ওভাই’ও তাদের মোটরবাইক পরিষেবা বন্ধ ঘোষণা করে। কারণ, উভয় প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেগাসিটিগুলোতে যানজট এড়াতে দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে রাইড শেয়ারিং ইন্ডাস্ট্রির এখনও সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু করোনা সংক্রমণ রোধে আরোপিত সরকারি নির্দেশনা মেনে গত বছরের ২৬ জুন থেকে বেশ কয়েকবার রাইড শেয়ারিং কার্যক্রম স্থগিত করায় কোম্পানিগুলো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। 

ওভাই সলিউশনের কর্পোরেট এবং রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ম্যানেজার সৈয়দ ফকরুদ্দিন মিল্লাথ দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেছেন, ওভাই মহামারি চলাকালে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের প্ল্যাটফর্মে ৫ লাখেরও বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী এবং বর্তমান বাজারের চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় নিয়ে যুক্তিসঙ্গত নতুন কৌশল নিয়ে আমরা সামনের দিনগুলোর ভালো একটি সময়ের জন্য কাজ করছি। কৌশলের অংশ হিসাবে, গাড়ি এবং সিএনজি চালিত অটোরিকশা পরিষেবা জন্য সম্পূর্ণ ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম চালু করেছে ‘ওভাই’।

সাম্প্রতিক দ্য বিজনেস পোস্ট’কে ‘সহজ’ কর্তৃপক্ষ জানায়, গত বছরের লকডাউনের কারণে বন্ধ করা রাইডশেয়ারিং পরিষেবা পুনরায় শুরু করেনি। কারণ, এ সময়ে খাতটি অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

এসব রাইড শেয়ারিং কোম্পানির অনেক ব্যবহারকারী ও চালক অন্য প্ল্যাটফর্মে চলে গেছেন। এখন তারা অ্যাপ ব্যবহার করার পরিবর্তে সরাসরি চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় যাতায়াত করে আসছেন, যা কোম্পানিগুলোকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

চালকদের দাবি, তারা যাত্রীদের কাছ থেকে তেমন একটা রাইডের কল পান না। আর এ কারণেই উবার ও পাঠাও ছাড়াও অন্যান্য রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারেও তার নিরুৎসাহিত।

এখন পর্যন্ত অন্য ১০টি সরকারি তালিকাভুক্ত ডিজিটাল রাইডশেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয়তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।

পাঠাও-এর সভাপতি ফাহিম আহমেদ বলেন, অ্যাপগুলো ব্যবহার না করে চুক্তিভিত্তিক যাত্রায় চালক ও যাত্রী উভয়ের জন্যই নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াতে পারে। আমরা উভয় পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সাথে ক্রমাগত কাজ করছি। এছাড়াও, আমরা রাইডার এবং যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও প্রচারণার ব্যবস্থা করছি।

তার মতে, প্ল্যাটফর্মটির এখন ৭ মিলিয়নেরও বেশি ব্যবহারকারীকে এ পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে এবং ৩ লাখ ড্রাইভার অ্যাপটির সাথে নিবন্ধিত হয়েছেন।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, যদি ব্যবহারকারীরা এ অ্যাপ ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের লাভ কী এবং নিরাপত্তার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহি করার মতো যে সুবিধাগুলো রয়েছে এ সম্পর্কে তাদের জানানো খুবই জরুরি।

কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য যদি মানুষ এ সিস্টেম ব্যবহার না করে, তাহলেতো তারা এ সুবিধা পাবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অসন্তোষ, রাস্তায় বিশৃঙ্খলা

অদক্ষ ও বেপরোয়া চালকদের ভিড় আর বাড়তি ভাড়ার কারণে চালক ও যাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা রাইড-শেয়ারিং ড্রাইভার ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ বলেন, একজন চালক যিনি দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করেন, তিনি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ টাকা ইনকাম করতে পারেন। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ জ্বালানি এবং রক্ষণাবেক্ষণে চলে যায়। আর অ্যাপ-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলো ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন নেয়। এসব খরচ বাদ দিলে গাড়ির চালকদের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ। কারণ, তাদের গাড়ি সচল রাখতে হলে আরও অন্যান্য খরচ রয়েছে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি উবার আমাদের একটি নোটিশ পাঠিয়েছে। আমাদের আয় ১৫ শতাংশ বাড়ানো হবে, তবে এ অংশটি যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হবে। কোম্পানিটি এতোই ‘লোভী’ যে এ থেকেও ২৫ শতাংশ কেটে নেবে। আমরা যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে নিরুৎসাহিত করতে চাই না। আমরা রাই শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের কমিশন ১০ শতাংশে কমিয়ে আনতে বলেছি।

উবার সম্প্রতি এক বিবৃতিতে দ্য বিজনেস পোস্ট’কে জানায়, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ বা ভারতে ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে।

বিবৃতিতে বলা হয়, সব সময় একটি অ্যালগরিদম ব্যবহার করে অগ্রিম গণনা করা হয় ভাড়া। যা ট্রিপ শুরুর স্থান এবং গন্তব্যের মধ্যে আনুমানিক ট্রিপের সময় এবং দূরত্ব, স্থানীয় ট্র্যাফিক অবস্থা বিবেচনা করে নির্ধারিত হয়৷ যখন বেশি চাহিদা থাকে, তখন মডেল অনুযায়ী ভাড়া বেশি হতে পারে, যা রাইডারদের পিক আওয়ারে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করে।

চালকদের দাবি অনুযায়ী বর্তমান কমিশন কমিয়ে আনার পরিকল্পনা কোম্পানির রয়েছে কিনা জানতে চাইলে উবার জানায়, বাংলাদেশে একটি নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম বজায় রাখতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। ড্রাইভার এবং যাত্রীরা যাতে সর্বোত্তম পরিষেবা পান তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কমিশন প্রযুক্তি এবং অন্যান্য সব কিছু সমাধানে উবারের পুনঃবিনিয়োগের প্রয়োজন।

পেশা হিসাবে গ্রহণ

রাইডশেয়ারিং চালকদের একটি প্রতিষ্ঠানিক পেশায় যুক্ত হওয়া কেন কঠিন, সেই ব্যাখ্যা দেন ঢাকা রাইড-শেয়ারিং ড্রাইভার ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ। তিনি বলেন, মহামারি তাদের অনেককে আগের পেশা ছাড়তে বাধ্য করেছে, অনেকে আবার ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েছেন।

তিনি দাবি করেন, এ সেক্টরে প্রায় ৪ লাখ চালক সার্বক্ষণিক রাইডশেয়ারিং পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

তার অ্যাসোসিয়েশন রাইড শেয়ারিং চালকদের আনুষ্ঠানিক পেশাদার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার এবং সরকারকে এ সেক্টর এবং চালকদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য একটি নতুন নীতি প্রণয়নের দাবি করে আসছে।

বাজার থেকে সরে যাওয়া স্টার্টআপের সংস্কৃতি

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাইডশেয়ারিং কোম্পানিগুলোর লাভের পর্যায়ে যেতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সময় লাগে, এটা খুব স্বাভাবিক। এটি যে শুধু দেশীয় বাজারেই সীমাবদ্ধ তা নয়, বিশ্বব্যাপী একই অবস্থা।

লোকসান কমাতে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো কর্মীদের ছাঁটাই করেছে। এছাড়া, খাদ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য পরিষেবা প্রদানে তাদের ব্যবসায় বৈচিত্র্য এনেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বেসিস সভাপতি বলেন, বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। কারণ ঢাকার মতো একটি ছোট এলাকায় অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী রাইড শেয়ারিং কোম্পানি রয়েছে, যে খাতটি এখানে কেবল শুরুর পর্যায়ে।

এ খাতের কিছু কোম্পানি মার্কেট থেকে সরে যাওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, স্টার্টআপদের জন্য কোম্পানিকে লাভজনক বা জনপ্রিয় করে তোলা এবং তারপর এটি অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রি করা বা আরও বিনিয়োগ সুরক্ষিত করার ঘটনা বিশ্বব্যাপী ঘটে।

বড় বিনিয়োগকারীর মধ্যে যারা এ স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করেন, তারা জানেন বেশিরভাগ কোম্পানি-ই সফল হবে না। বিশ্বের স্টার্টআপ অঙ্গনে সফলতার হার ১০ শতাংশেরও নিচে। আর বাকি ৯০ শতাংশই দুই বছরে মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু যখন কেউ ইউনিকর্ন বা বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হয়ে ওঠে, তখন এটি যে কোনো সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে।

করোনা মহামারি চলাকালে স্টার্টআপগুলো উল্লেখযোগ্য ক্ষতির মুখে পড়ে। বেসিস সভাপতি বলেন, যদি কোম্পানিগুলো সময়োপযোগী কৌশল বিকাশ করতে না পারে, তাহলে তারা ব্যর্থ হবে।