চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির উপর নির্মিত হচ্ছে আধুনিক অর্থনীতি। এর বড় উদাহরণ হল- উৎপাদনশীল ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহৃত রোবটের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির উপর এমন নির্ভরতা আরও বাড়বে।
তবে স্পিনিং মিল থেকে অটোমোবাইল, প্লাস্টিক শিল্প, কৃষিখাত, ইলেকট্রনিক, রপ্তানিমুখী আসবাবপত্রসহ অনেক ক্ষেত্রে যে পরিমাণ রোবট ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি থাকার কথা, তা বাস্তবে হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, আগামী দশকে রোবটের ব্যবহার ছাড়া মেগা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে পারবে না।
হাই-টেক পার্কের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ইতোমধ্যে রোবোটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে উন্নত দেশগুলো। এর ফলও ভোগ করছে তারা। স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ীও আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। আমরাও উন্নত দেশগুলোর মতোই ইকো-টেকনোলজি এবং রোবটের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সক্ষম হতে চাই।
তিনি জানান, দেশে এই মুহূর্তে বিপুল সংখ্যক রোবট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা কঠিন। কিন্তু আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যেই তা সম্ভব হবে।
ইতিমধ্যে দেশের পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোটিক্স প্রোগ্রামিং কোর্স চালু করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সহযোগিতায় এ কোর্স চালু হয়েছে। এছাড়াও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও এ পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
এদিকে অটোমেশনের মাধ্যমে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ থেকে শুরু করে আসবাবপত্র উৎপাদন, এছাড়াও বিভিন্ন শিল্পে খরচ কমানোসহ গুণগত মান উন্নত করা সম্ভব। এছাড়াও বর্তমানে রোবোটিক্স ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত বাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।
রোবোটিক্স ব্যবহার ছাড়া শুধু জনশক্তির শ্রমের উপর নির্ভর করে ব্যয় কমানো সম্ভব নয়। কারণ রোবটের ব্যবহারে খরচ অনেক কম এবং পণ্যের গুণগত মানও বাড়ানো সহজ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর রোবট ব্যবহার না করে নির্ভুলভাবে কাজ এবং নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলি মেনে চলা প্রায় অসম্ভব। এর ফলে রোবটের ব্যবহার রপ্তানি বাজারের সম্ভাবনা তৈরির জন্যও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ইতোমধ্যে দেশে রোবোটিক্সের জাতীয় কৌশল অনুসারে, তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিং, চামড়া, কৃষি এবং ফার্মাসিউটিক্যালসসহ অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে অটোমেশন চালু হয়েছে। এমনি একটি প্রতিষ্ঠান এনভয় টেক্সটাইল লিমিটেড (ইটিএল)।
ডেনিম ব্র্যান্ডের কাপড় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি পণ্যের গুণমান মান উন্নত করতে রোবোটিক্স যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে। সুতা উৎপাদনসহ, পোশাক তৈরি নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যেই স্পিনিং বিভাগে রোবোটিক্স যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে শীর্ষস্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরে পোশাক উৎপাদনের জন্য রোবটিক্স যন্ত্রপাতি ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, রোবোটিক্স প্রযুক্তিতে এককালীন অল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে আরও বেশি উৎপাদন এবং সুতার গুণগত মান নিশ্চিত করা যায়।
ব্যবসায়িক এ তাইকুন আরও বলেন, মানুষের তুলনায় ১০ গুণ দ্রুত কাজ করতে পারে রোবট। আমাদের যখন ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত চালান পাঠাতে হয়, সেক্ষেত্রে অটোমেশনের কোন বিকল্প নেই। এ প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা জরুরী অবস্থা ও ক্রেতার চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে দক্ষ প্রযুক্তিবিদদের অভাব রয়েছে। তবে আমি মনে করি, এ ধরণের মেশিনের সমস্যাগুলো অবশ্যই রোবটিক্স পণ্য নির্মাতা প্রযুক্তিবিদদের দ্বারা সমাধান করা উচিত।
বাংলাদেশের আসবাবপত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হাতিল। প্রতিষ্ঠানটি তাদের কারখানায় স্বয়ংক্রিয় রোবটিক্স সিস্টেম ব্যবহার করছে। রোবট ব্যবহারে প্রতিষ্ঠানটির পণ্যের গুণমান মান উন্নত হয়েছে ও বিভিন্ন বিভাগে বর্জ্যের পরিমাণও কমেছে।
হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান বলেন, আমরা একটি জার্মান কোম্পানির রোবটিক্স সিস্টেম ব্যবহার করছি। যে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি তারা সেখান থেকেই পর্যবেক্ষণ এবং সমাধান করছে।
রোবোটিক্সের জাতীয় কৌশল অনুসারে, রোবটগুলির সাথে যৌথভাবে কাজ করার ক্ষমতাসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে দেশে। যা সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং স্টার্ট-আপগুলি অনুসরণে যুবকদের ক্ষমতায়নের বিশাল সুযোগের জন্য একটি বড় বাধা।
ইতিমধ্যে বুয়েট, রুয়েট, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রোবোটিক্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে কোর্স ও প্রশিক্ষণ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
রোবোটিক্স অ্যান্ড অটোমেশন সোসাইটির ভাইস-চেয়ারম্যান এবং বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) অধ্যাপক ড. শেখ আনোয়ারুল ফাত্তাহ দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতার কারণে আমাদের রোবটিক্স যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও উৎপাদনে উপযুক্ত শ্রমের অভাব রয়েছে।
তিনি বলেন, যেহেতু উৎপাদন প্রক্রিয়ায় রোবোটিক্স, অটোমেশন, মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধীরে ধীরে তাদের পথ তৈরি করে, সেহেতু চাকরির বাজার এবং অর্থনীতিতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় প্রভাব পড়বে।
তিনি আরও বলেন, এটাও সত্য যে রোবট এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ফলে কারখানায় ভারি ও বিপজ্জনক কাজগুলোতে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। তবে একই সাথে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। যেখানে দক্ষ কর্মীদের চাহিদা অনেক বেশি।
এ বিষয়ে বুয়েটের এ অধ্যাপক আরও বলেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দেশের জনগণকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। যেন তারা প্রযুক্তিগত বিষয়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিজেদের উচ্চ বেতনের চাকরির জন্য গড়ে তুলতে পারে।