প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

নতুন বিতর্কে ইভ্যালি, অডিট রিপোর্টও ভুয়া

১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:২৭:০০ | আপডেট: ৩ years আগে
নতুন বিতর্কে ইভ্যালি, অডিট রিপোর্টও ভুয়া

মিরাজ শামস

গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের সঙ্গে প্রতারণার নানা অভিযোগে অভিযুক্ত বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি এবার অডিট নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি এন্ড ফার্মস (আরজেএসসি) রেজিস্ট্রারের কাছে কোম্পানিটি জমা দিয়েছে একটি ‘প্রতারণামূলক’ অডিট রিপোর্ট।

গত ২ আগস্ট আরজেএসসিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী জমা দেয় ই-ট্রেডার। যা পরবর্তীতে
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুতই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে।

এসআর ইসলাম অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের প্যাডে ওই অডিট প্রতিবেদন তৈরি করা হলেও, সেটি তারা প্রস্তুত করেনি বলে দাবি করেছে নিরীক্ষা সংস্থাটি। তাদের দাবি, তারা এটি করেনি, ই-কমার্স কোম্পানি ইভ্যালি নিজেই নিজেদের স্বার্থে মিথ্যা এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

দ্য বিজনেস পোস্টে’র সঙ্গে আলাপকালে ইসলাম অ্যান্ড কোং-এর ম্যানেজিং পার্টনার সাইফুল আলম বলেন, আমি গত ছয় বছর ধরে ফার্মের সঙ্গে আছি। আমার জানামতে, আমাদের ফার্ম থেকে কোনো আর্থিক প্রতিবেদন ইভ্যালির জন্য প্রস্তত করা হয়নি।

তিনি বলেন, আমরা যেসব অডিট রিপোর্ট প্রস্তুত করি, তা প্রতি বছর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামসহ ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশে (আইসিএবি) জমা দেয়া হয়।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখিত অডিট ফার্মের নাম ও ঠিকানা সম্পর্কে সাইফুল আলম বলেন, কেউ হয়তো ইসলাম অ্যান্ড কোং-এর প্যাড পুনরায় তৈরি করে এটি বানিয়েছে।

এ বিষয়ে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি তার মোবাইল ফোন ধরেননি। এমনকি, তাকে পাঠানো ম্যাসেজের উত্তরও দেননি তিনি।

গত মঙ্গলবার বিকেলে যখন এ প্রতিবেদক রাজধানীর ধানমন্ডিতে ইভ্যালি কার্যালয়ে গিয়েছিলেন, তখনও তার সাথে দেখা করা সম্ভব হয়নি। যদিও কোম্পানির ওয়েবসাইট বলছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

কোম্পানিটির প্রধান কোথায় আছেন, এমন প্রশ্নে ইভ্যালির কর্মীরা জানান, তাদের বস রাতে কাজ করেন। তিনি রাত ৮টা থেকে রাত ৯টার দিকে অফিসে আসেন। অন্য কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে কথা বলার সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে, নেই বলে জানান তারা।

ইভ্যালি’র অডিট বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানিটির অডিট ম্যানেজার সৈয়দ মাহাদী ফোনে দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, এসআর ইসলাম অ্যান্ড কোং এর অনেক অংশীদার থাকতে পারে। তাদের মধ্যে একজন অবশ্যই নিরীক্ষা করেছেন, এটি এমন হতে পারে যে অন্যরা এটি সম্পর্কে জানেন না।

মাহাদী এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন, এ বিশেষ অডিটের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন না।

তিনি দৃঢ়ভাবে দাবি করেন, অডিট রিপোর্ট তৈরির সাথে জড়িত এসআর ইসলাম অ্যান্ড কোং পার্টনারের সাথে কথা বলেছে ইভ্যালি এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটি তা প্রকাশ করতে বলেছে যে, এ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্ম ইভ্যালির আর্থিক নিরীক্ষা করেছে।

আইসিএবিতে জমা দেয়া ১৬৮টি কোম্পানির মধ্যে এসআর ইসলাম অ্যান্ড কোং-এর অডিট লিস্টে ইভ্যালির নাম নেই কেন, জানতে চাইলে মাহাদী বলেন, অডিট নেটওয়ার্কে একজন সক্রিয় ক্লায়েন্ট প্রবেশ করার সময় এটি তালিকাভুক্ত হয়; কিন্তু তা জরুরি বিষয় নয়।

সব অডিট ফার্ম-ই অডিট করা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম তালিকাভুক্ত করে থাকে। যদিও এমন কিছু আছে যেগুলোর অডিট করার পরও ওই কোম্পানি নাম তাদের তালিকায় রাখে না। তার দাবি, সিএ ফার্ম ইভ্যালির মতো আরও অনেক কোম্পানির অডিট করেছে, কিন্তু তাদের সবাইকে তালিকাভুক্ত করেনি।

মাহদী বলেন, এসআর ইসলাম অ্যান্ড কোং এর ম্যানেজিং পার্টনার সাইফুল আলম হয়তো তার কাজপত্র অনুযায়ী বলেছেন, যেখানে ইভালির নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। আইসিএবিতে তালিকাভুক্ত অনেক সংস্থা রয়েছে এবং সেখানেও অনেকগুলি তালিকাভুক্ত নয়।

ইভ্যালি হওয়াতেই এমনটি হতে পারে উল্লেখ করে মাহদী এ প্রতিবেদককে বলেন, যদি আপনি এখন সাইফুলের সাথে যোগাযোগ করেন তাহলে তিনি অবশ্যই আপনাকে বলবেন তারাই অডিটটি করেছেন।

ইভ্যালির কর্মকর্তার সাথে কথোপকথনের পরপরই দ্য বিজনেস পোস্ট আবার সাইফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করে। সেই সময়ও একইভাবে ইভ্যালির অডিট ম্যানেজারের দাবি আরও স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।

সাইফুল ইভ্যালিকে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ই-কমার্স কোম্পানিটিকে প্রমাণ করতে বলুন, তারা ইসলাম অ্যান্ড কোং থেকে অডিট রিপোর্ট পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম, আত্মসাৎ এবং অর্থ লোপাটের জন্যই এ মিথ্যা অডিট রিপোর্ট করা হয়েছে। তাছাড়া, অর্থ পাচার কেলেঙ্কারিও করতে পারে ইভ্যালি। অডিট প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে যাচাই-বাছাই করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেন তারা।

ইভ্যালিকে চাপের মধ্যে রাখতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদি তাদের জবাব সন্তোষজনক না হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, এ অভিমত দেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট শাহ মুহাম্মদ এজাজ রহমান বলেন, ফৌজদারি আইনে প্যানেল আদালতে মামলা করা যেতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা আরজেএসসি কোম্পানি আইনের অধীনে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও মামলা করতে পারে। পাওনাদার এবং শেয়ারহোল্ডাররাও এ বিষয়ে মামলা করতে পারেন।

কোম্পানির আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, আর্থিক হিসাব গোপন করা অন্যায়। এ জালিয়াতির ব্যাপারে মামলা করতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কোম্পানির গ্রাহক এবং শেয়ারহোল্ডাররাও এর জন্য মামলা করতে পারেন।

তিনি বলেন, কর ফাঁকি দেয়ার জন্য ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করে অনেকে। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচিত আইনি ব্যবস্থা নেয়া। অনুমতি ছাড়া প্যাড ব্যবহার এবং অডিটরের নাম ব্যবহার করে ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের অভিযোগে ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন অডিট ফার্মটিও।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ইভ্যালির অডিট রিপোর্ট মিথ্যা কিনা, তা যাচাই করবে মন্ত্রণালয়। জালিয়াতির কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিভাগ, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, ই-ক্যাব এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি শিগগিরই বৈঠক করবে এবং পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ইভ্যালির সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, অনলাইন শপিং মলটির অনেক অনিয়ম রয়েছে।

তিনি বলেন, শুধু আমি নই, যদি কোনো নির্বাহী প্রশ্ন তেলেন, তাহলে তাদের চাকরি হারানোর ভয় রয়েছে। ছাঁটাইয়ের ভয়ে কেউ টু-শব্দও করছে না।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে ইভ্যালি । ২০১৯-২০ অর্থবছরের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, কোম্পানিটির চালু হওয়ার ৬ মাসের মাথায় ২ লাখ ২৯ হাজার টাকার লোকসান হয়। ২০১৯ ও ২০২০ অর্থবছর শেষে, ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২ কোটি ৩৮ লাখ এবং ১০৩ কোটিরও বেশি।

যদিও কোম্পানিটির দাবি, জুন ২০১৯ এর শেষে অদৃশ্য সম্পদ ছিল ৫৪ লাখ টাকার। জুন ২০২০ এর শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ১২ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। এটি এখন ৪৩৮ কোটি ৪৫ লাখে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন ২০২০ পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছ থেকে ইভ্যালি অগ্রিম আদায় করেছে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এখন তার সরবরাহকারীদের কাছে দেনা ৯ কোটি টাকারও বেশি।

এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দুটি ভিন্ন তথ্য সংবলিত রিপোর্ট জমা দেয় ইভ্যালি। সেসব প্রতিবেদনে কোম্পানিটি জানায়, যথাক্রমে ৩১১ কোটি এবং ২০৬ কোটি টাকা গ্রাহক এবং সরবরাহকারীদের কাছে তার দেনা রয়েছে।

আইসিএবি’র এক সদস্য বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইভ্যালির হিসাব বিবরণীতে কিছু ঝামেলা রয়েছে।

ওই সদস্য জানান, কোম্পানির অদৃশ্য সম্পদের হিসাব করার সময় কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। কিন্তু ইভ্যালির ক্ষেত্রে এটি করা হয়নি।