প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.২৭ টাকা

রোকন উদ্দিন
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:৫৭:১৫ | আপডেট: ২ years আগে
প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.২৭ টাকা

দেশে স্বল্প আয়ের মানুষের আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস ডিম। গত কয়েক মাস ধরে ডিমের দামে লক্ষ্য করা গেছে  অস্বাভাবিক অস্থিরতা। ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ডিমের দাম বেড়ে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। মাঝে দুই সপ্তাহ কিছুটা কম দামে বিক্রি হলেও আবারও বাড়ছে দাম। এতে সাধারণ মানুষের আমিষ ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে বিজনেস পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন এ খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসিন।

বিজনেস পোস্ট: ডিমের দাম কিছুদিন কম থাকলেও পুনরায় বাড়ার কারণ কী?

ডিমের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ তিনটি। প্রথমটি হলো সম্প্রতি মিল মালিকরা পোল্ট্রিফিডের দাম কেজি প্রতি ২.৫ টাকা বাড়িয়েছে। এতে ডিমের উৎপাদন খরচ আরো বেড়েছে। আগে লেয়ার ফিডের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৬ টাকা, যা এখন ৫৮.৫ টাকা কেজি। বর্তমানে ডিম উৎপাদনে ৭৬ শতাংশ খরচই হচ্ছে খাদ্যে। ফিডের দাম স্বাভাবিক থাকলে খাদ্যে খরচ হতো ৭০ শতাংশ।

দ্বিতীয়ত ডিমের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে গেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় ডিমের বাজারেও ঘাটতি রয়েছে। খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় প্রতিনিয়তেই খামার বন্ধ হচ্ছে। অনেকে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। খামারে ধারণ ক্ষমতার অনেক কম মুরগি পালন করছেন উদ্যোক্তারা। এ বিষয়টিও ডিমের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ডিমের দাম যদি কিছুটা না বাড়তো তবে আরো অনেক খামারি ঝরে পড়তো।

তৃতীয়ত আবহাওয়াগত কারণে সরবরাহ বিঘ্নিত হলেও মাঝে মাঝে দাম বাড়ে। তবে সেটি বেশিদিন স্থায়ী হয় না। যেমন গত কয়েক দিন আগে টানা বৃষ্টির কারণে দাম হঠাৎ বেড়েছিল। তবে এখন আবার কিছুটা কমেছে।

বিজনেস পোস্ট: বর্তমানে ডিম উৎপাদনের খরচ কেমন, যে দামে বিক্রি হচ্ছে তা কী যৌক্তিক?

বর্তমানে ছোট ফার্মগুলোর প্রতিটির ডিম উৎপাদন খরচ হয় ১০.২৭ টাকা, আর বড় ফার্মগুলোর কিছুটা কম ১০ টাকা। খাদ্যের দাম, ইউটিলিটি চার্জ, লেবার ইত্যাদি সামগ্রিক খরচ যোগ করে সম্প্রতি কয়েকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদসহ (বিপিকেআরজেপি) কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে তথ্যের ভিত্তিতে ডিমের এই উৎপাদন খরচ বের করেছে। খামারিকে মুনাফা করতে হলে এই খরচের চেয়ে বেশিতে বিক্রি করতে হবে। উৎপাদন খরচের এই প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জমা দেয়া হয়েছে। তাদের যাচাই বাছাইয়ের পর এটি চুড়ান্ত করা হবে।

বিজনেস পোস্ট: প্রতিবেশি দেশগুলোতে প্রতি পিস ডিমের খুচরা দাম ৭.৫০-৮ টাকা, আমাদের দেশে ১১.৫০ টাকা, পাশাপাশি দেশ হয়েও আমাদের দাম এত বেশি কেন?

আমাদের দেশে ডিমের দাম বেশি হওয়ার প্রধান দুটি কারণ- একটি হলো তারা ছোট ডিমের ব্রিড ব্যবহার করে আমাদের হয় বড় ডিমের। ফলে তাদের মুরগির ডিম আমাদের মুরগির ডিমের চেয়ে আকারে ছোট হয়। যেমন ভারতের খামারিরা যে পরিমান খাদ্য দিয়ে ৫০০ ডিম উৎপাদন করেন আমরা সে পরিমান খাদ্য দিয়ে ৩৮০টি ডিম পাই।

দ্বিতীয় কারণ হলো তাদের খাদ্যমূল্য কম। তাদের খাদ্যের কাঁচামাল গম, সয়াবিন, ভুট্টাসহ সবকিছুই নিজেদের উৎপাদিত। আমরা তাদের কাছ থেকেই আমদানি করি। ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি। এছাড়া তাদের দেশে সাদা ডিম চলে বেশি, এর উৎপাদন খরচ কম। তাদের তুলনায় আমাদের পরিবহন ব্যয়, জীবন যাত্রার ব্যয়সহ অন্যান্য খরচের পার্থক্যও রয়েছে।

বিজনেস পোস্ট: দেশে ডিমের উৎপাদন কেন কমছে, কি পরিমাণ কমেছে?
খামার পর্যায়ে উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয় মূল্য কম হওয়ায় পুঁজি হারাতে হারাতে প্রতিনিয়তই খামারি ঝরছে। বর্তমান মূল্যে বিক্রি হলেও খামার ঝরবে। কারণ উৎপাদনে খরচ ১০.২৭ টাকা বিক্রি ১০ টাকা। শনিবার গাজীপুরের খামারিরা ডিম বিক্রি করেছেন প্রতি পিস ৯.৮০-১০ টাকা। সে হিসেবে খামারিরা লোকসানে রয়েছেন।

আমাদের হিসাব বলে বর্তমানে দেশে ৭৯-৮১ হাজার লেয়ার ব্রয়লার খামার রয়েছে। যা চলতি বছরের শুরুতেও ৮৮-৮৯ হাজারটি ছিল। এর আগে ২০১০ সালে খামারির সংখ্যা ছিল ১,১৪,৭২০টি। ওই সময় বার্ডফ্লুতে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে ডিমের দাম বাড়তে থাকায় আবার খামারের সংখ্যা বেড়ে ২০১৬ সালে ১,৪৬,০০০ দাঁড়ায়। তবে খাদ্যের দাম বৃদ্ধিসহ নানা করণে খামার বন্ধ হয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৮ হাজার খামার বন্ধ হয়েছে। অনেক খামার পুরোপুরি বন্ধ হয়নি কিন্তু উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা ৩ হাজার মুরগি ওঠাতো তারা ১-২ হাজার তুলেছে।

এতে ডিমের উৎপাদনও কমেছে। গত ৬-৮ মাসে দেশে দৈনিক ডিমের উৎপাদন কমেছে ২৭ লাখের বেশি। ছয়মাস আগেও প্রতিদিন দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ৪.৪২-৪.৫৫ কোটি পিস।

বিজনেস পোস্ট: ডিমের বাজার নিয়ে অনেকে সিন্ডিকেটের অভিযোগ তুলছেন, এটা কতটা ঠিক?
ডিম পচনশীল পণ্য হওয়ায় বেশি দিন মজুদ করে রাখা যায়না। ফলে ছোট ছোট খামারগুলো বাজারে সিন্ডিকেট করার প্রশ্নই আসে না। এখন পর্যন্ত দেশের ৭৮ শতাংশ ডিম উৎপাদন করে ছোট খমারিরা। বড়রা করে ২২ শতাংশ। ফলে ডিমের বাজারে সিন্ডিকেট হচ্ছে এমন কথার যৌক্তিকতা দেখছি না। তবে বড়রা আস্তে আস্তে উৎপাদন যে ভাবে বাড়াচ্ছে এবং বিপরীতে ছোটরা যে হারে ঝরে যাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে সিন্ডিকেট হবে না তা বলা যাচ্ছে না।
এখন যেমন বড় মিলগুলো সিন্ডিকেট করে পোল্ট্রি ফিডের দাম বাড়াচ্ছে, খুব শীঘ্রই হয়তো ডিমের বাজারেও এমন পরিবেশ তৈরি হবে। দেশে পোল্ট্রি ফিড তৈরি করে হাতে গোনা বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা যেভাবে চায় পোল্ট্রি খাদ্যের দাম সেভাবেই নির্ধারণ হয়।

বিজনেস পোস্ট: এমন পরিস্থিতিতে করণীয় কি? কি ব্যবস্থা নিলে খামারি বাঁচবে এবং বাজারে স্থিরতা ফিরে আসবে?

সরকারের উচিৎ পোল্ট্রি ফিড তৈরি থেকে ডিম ও মুরগির উৎপাদন খরচ বের করা। সে অনুসারে প্রফিট মার্জিন ঠিক করে দাম বেধে দেয়া। সে অনুসারে বাজার মনিটরিং করা। তা হলে খামারি ও সরবরাকারী সবাই বাচবে।