প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের

মেহেদী আল আমিন
২৩ আগস্ট ২০২২ ১৫:১৩:১৬ | আপডেট: ৩ years আগে
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের

বাংলাদেশের চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম এবং আফ্রিকার দারিদ্র্যপ্রবণ দেশ কেনিয়ার চেয়েও প্রায় পাঁচগুণ কম।

বাংলাদেশের একজন শ্রমিক দৈনিক ১২০ টাকা আয় করেন, যা এখন এক ডজন ডিম কেনার জন্যও যথেষ্ট নয়। সেখানে অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা এর থেকে অনেক বেশি মজুরি পান।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী; কেনিয়াতে একজন চা শ্রমিক দৈনিক ৫৮৩ টাকা আয় করেন, বাংলাদেশের শ্রমিকদের চেয়ে যা প্রায় ৪.৮৫ গুণ বেশি।

এমনকি ইতিহাসের সবচেয়ে অর্থনৈতিক সংকট এবং ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়নের মধ্যেও শ্রীলঙ্কার চা বাগানের শ্রমিকরা এখনও বাংলাদেশি শ্রমিকদের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পান।

স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা যায়; একজন শ্রীলঙ্কান চা শ্রমিক দৈনিক ২৬৪ টাকা (স্থানীয় মুদ্রা থেকে টাকায় রূপান্তরিত) আয় করেন এবং নেপালের শ্রমিকরা প্রতিদিন ভাতা ব্যতীত ৩২৪ টাকা পান।

বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতে চা শ্রমিকদের মজুরি একেক রাজ্যে একেক রকম। তবে সব রাজ্যে মজুরি এখনও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি।

দ্য হিন্দু এবং টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে কেরালায় চা শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি বেতন পান। তাদের দৈনিক মজুরি ৫০৩ টাকা।

দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কর্ণাটক যেখানে ৪৪৯ টাকা পারিশ্রমিক দেয়া হয়। তামিলনাড়ুতে ৪০৬.৮০ টাকা পশ্চিমবঙ্গে ২৭৬ টাকা। আসামে ২৫১ টাকা, ত্রিপুরায় ২১০ টাকা এবং বিহারে ২০৯ টাকা।

২০২০ সালে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে ভিয়েতনামে একজন চা শ্রমিক ৩০৫ টাকা পারিশ্রমিক পান।

সেখানে প্রতিদিন ১২০ টাকা বেতনে বাংলাদেশের শ্রমিকরা তাদের পরিবারের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের দাবি, মালিকরা নানাভাবে তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে।

শ্রীমঙ্গলের একটি চা বাগানে কাজ করেন কার্তিক নায়েক। দ্য বিজনেস পোস্ট’কে তিনি বলেন; ‘আমার সাত সদস্যের পরিবার। আমিই একমাত্র উপার্জন করি। আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে খন্ডকালীন কাজ করে। দৈনিক ১২০ টাকা দিয়ে এত বড় পরিবার আমি কীভাবে চালাবো?’

তিনি বলেন; ‘বাগান মালিক বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে আমাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে। আমাদের সমাধান দরকার।’

তবে চা বাগান মালিকদের প্রতিনিধি সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) গত ১৭ আগস্ট এক বিবৃতিতে দাবি করেছে; চা বাগানের শ্রমিকরা প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০০ টাকা মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা পান। অনেকেই তাদের এ দাবি অস্বীকার করেছেন।

বিটিএ চেয়ারম্যান এম শাহ আলম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন: ‘আমরা এমনভাবে মজুরি দিচ্ছি যাতে করে আমাদের এ শিল্প চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি এবং শ্রমিকরা তাদের পরিবার নিয়ে ঠিকমত চলতে পারে। আমাদেরকে চায়ের দামের ওপরেও নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি এবং এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের যা করা প্রয়োজন করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘একজন শ্রমিক বর্তমানে দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা পান।’

তিনি আরও দাবি করেন; ‘বাংলাদেশের তুলনায় কেরালায় ফলন ৩০ শতাংশ বেশি। তা সত্ত্বেও, সেখানে এবং ভারতের আরও কিছু এলাকায় বাগান মালিকরা শ্রমিকদের উচ্চ মজুরির কারণে ব্যবসা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিছু বাগান ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।’

তবে বিশেষজ্ঞ এবং শ্রমিক নেতারা বিটিএর এ দাবির সাথে একমত নন।

চা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ফিলিপ গেইন বলেন; ‘চা বাগান মালিকরা শ্রম আইনের অন্তত আটটি ধারা লঙ্ঘন করে এবং সমস্ত সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করলেও শ্রমিকদের দৈনিক বেতন প্রায় ২০০ টাকা হবে।’

তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে এ উপমহাদেশে চা বাগানগুলো ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য বহন করছে। উপমহাদেশের বাইরে অন্য কোনো দেশে এত সংখ্যক বড় বাগান নেই। জাপান, চীন, শ্রীলঙ্কা এবং অন্যান্য দেশে ক্ষুদ্র চা চাষীরা সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। এ কারণে এসব দেশে চা শ্রমিকরা বেশি আয় করে। এমনকি শ্রীলঙ্কায়ও প্রায় ৭০ শতাংশ চা সরবরাহ করেন ৩ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক।’

তিনি আরও বলেন, সুবিধা বাদ দিয়ে দৈনিক মজুরি ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হলে এ শিল্পের কোনো অসুবিধা হবে না।

দ্য বিজনেস পোস্টে’র সাথে আলাপকালে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের (বিটিডব্লিউইউ) সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন; ‘ভারতে শ্রমিকরা ভালো বেতন পান। তাদের সাথে তুলনা করে আমরা ৩০০ টাকা দাবি করেছিলাম। তবে মালিকপক্ষের প্রস্তাবিত ১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরিতেও রাজি নয় শ্রমিকরা।’

‘সরকার পরিস্থিতি সমাধানের জন্য সময় চায়। তাই আমরা তাদের সময় দিয়েছি এবং আপাতত ১২০ টাকায় আমাদের কাজ আবার শুরু করেছি। আমরা আশা করছি সরকার ১৫ দিনের মধ্যে দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা নির্ধারণ করবে।তবে বিভিন্ন চা বাগানের অনেক শ্রমিক কাজে ফিরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা হয়তো বুঝতে পারেনি আমরা কী করতে চাইছি। তিনি বলেন; আমরা ১২০ টাকা বা ১৪৫ টাকায় রাজি নই। সরকার ১৫ দিনের মধ্যে দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা নির্ধারণ না করা পর্যন্ত আমরা ১২০ টাকায় কাজ করবো।’

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার চা বাগান শ্রমিক রয়েছে। এদের মধ্যে ১ লাখ চা খাতের একমাত্র শ্রমিক সংগঠন বিটিডব্লিউইউ-এর সদস্য বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী; ২০২১ সালে ৯৬.৫০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল। এক দশক আগে, ২০১১ সালে এই পরিমাণ ছিল ৫৯.১৩ মিলিয়ন কেজি।

২০২১ সালে শুন্য দশমিক ৬৪ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যার মূল্য ১৮.০৫৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশে ২৭৯,৫০৬.৮৮ একর জমি জুড়ে ১৬৭ টি চা বাগান ও স্টেট রয়েছে।

এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৭৬টি স্টেট, হবিগঞ্জে ২২টি, চট্টগ্রামে ১৮টি, সিলেটে ১২টি এবং রাঙামাটিতে একটি এস্টেট রয়েছে।

অপরদিকে মৌলভীবাজারে ১৫টি, সিলেটে সাতটি, পঞ্চগড়ে আটটি, চট্টগ্রাম ও হবিগঞ্জে তিনটি করে এবং রাঙামাটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি করে চা বাগান রয়েছে।