মেহেদী হাসান
অদক্ষতা, অদূরদর্শিতার আর বিনিয়োগ পরিকল্পনার অভাবের পাশাপাশি পরিচালনায় অধিক ব্যয়সহ নানা কারণে ব্যর্থ হতে চলেছে ফিনটেক স্টার্টআপ ‘আইপে সিস্টেমস লিমিটেড’। এ শিল্প সংশ্লিষ্টরা এখন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তাদের ‘অপেশাদার’ বলে উল্লেখ করছেন।
অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করা আইপে-কে ফিনটেক শিল্পের আপতত পথপ্রদর্শক বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে এটি একটি ব্যর্থ উদ্যোগে পরিণত হয়।
সূত্র বলছে, বহুল আলোচিত ফিনটেক শিল্প এখন চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে। রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনে জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর উদ্বোধন হয়, যেখানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
এ উদ্যোগটির ব্যর্থতার পেছনে বিনিয়োগকারীদের অদক্ষতা, তাদের দূরদর্শিতার অভাব এবং যথাযথ বিনিয়োগ পরিকল্পনার পাশাপাশি অধিক ব্যয়-ই দায়ী।
আইপে সিস্টেমস লিমিটেড-এর উদ্যোক্তারা প্রাথমিকভাবে এখানে ৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। যদিও, শুরু পর থেকেই লোকসান গুনছিল প্রতিষ্ঠানটি।
ই-ওয়ালেট মার্কেটে মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারীদের একচেটিয়া ব্যবসা এবং ব্যাংকের অসহযোগিতা এ উদ্যোগের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির কারণ বলেও বলে মনে করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইপে’র কর্মকর্তারা বলেন, এখনও কোম্পানির ওয়েবসাইটটি তার উজ্জ্বল অতীতকে প্রতিফলিত করে, যদিও তার বেশিরভাগ পরিষেবাই কার্যত বন্ধ।
একেবারে শুরুতেই আইপে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছিল। কারণ, এটি ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে চুক্তি করেছে এবং প্রায় ৩০০ জন কর্মীও ছিল।
এমনকি এটি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আয়োজিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছে- যা এখন শুধুই স্মৃতি।
এ খাতে প্রথম হওয়ায় ফিনটেকের এ উদ্যোগ- কেনাকাটা, ইউটিলিটি বিল, ট্যাক্স, টিউশন ফি এবং ফান্ড ট্রান্সফারের জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট করার জন্য পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবন্ধন পায়।
কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকেই এটির অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং করোনা মহামারি শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিকে পুরোপুরি ব্যর্থ করে দেয়। করোনাকালে বিশ্বব্যাপী ফিনটেক কোম্পানিগুলোর বেশ উন্নতি হলেও আইপের বেলায় ঘটেছে এর পুরো উল্টো।
আইপে’র পরিচালক এবং সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল আহসান বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আমরা কিছুটা সংকটে আছি এবং এখন আমাদের কিছু বিনিয়োগ দরকার।
নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে শহিদুল আহসান বলেন, শুরুতে আমরা আইপে’তে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম, কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি কীভাবে এ ধরনের একটি ফিনটেক উদ্যোগ পরিচালনা করতে হয়। বিদেশি বিনিয়োগ আইপে-কে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে বলেও মনে করেন তিনি।
নামেই কেবল অফিস
কোনো কাজই হয় না প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে, যা প্রাণহীন বলে মনে হয়। বিজনেস পোস্ট-এর প্রতিবেদক সম্প্রতি রাজধানীর ৫২, গুলশান এভিনিউয়ের সিলভার টাওয়ারে (লেভেল ১২) কোম্পানির অফিসে গেলে এ দৃশ্য চোখে পড়ে।
কার্যক্রম শুরুর পর প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল আইপে’র, যে সংখ্যা এখন নেমে এসেছে মাত্র ১৩ জনে। এছাড়া, করোনাকালে বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন যারা অবশিষ্ট রয়েছেন তারাও নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না।
আইপে সূত্র জানায়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাকারিয়া স্বপন ও চেয়ারম্যান রেজাউল হোসেন অফিসে আসেন না, তারা কার্যত ভার্চুয়ালি অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
তিন হাজার ৫০০ এর অধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আইপে প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে এবং এর প্রায় ৭ লাখ গ্রাহক ছিল, তাদের মধ্যে প্রায় ১ লাখ এখনও সক্রিয় রয়েছে।
আইপে’র প্রধান পরিচালক
জাকারিয়া স্বপন ২০১৫ সালে আইপে প্রতিষ্ঠা করেন এবং শুরু থেকেই এর সিইও’র পদে রয়েছেন। আর রেজাউল হোসেন চেয়ারম্যান পদে নতুন নিযুক্ত হয়েছেন। রেজাউল গার্মেন্টস সেক্টরের গোল্ডস্টার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও।
রেজাউলের আগে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক শহীদুল আহসান আইপে’র চেয়ারম্যান হন; যিনি আহসান গ্রুপের চেয়ারম্যানও ছিলেন।
রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (আরএসআরএম) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুর রহমানও আইপে’র বিনিয়োগকারী।
সিইও জাকারিয়া স্বপন দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, তাদের পরিষেবা খোলা আছে কিন্তু মহামারির কারণে অফিস বন্ধ রয়েছে।
ছাঁটাইয়ের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা মহামারি চলাকালীন সময়ে টিমকে ছোট করেছি। কারণ আমাদের এখন এতো কর্মীর প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের ব্যাংকগুলো সম্পূর্ণরূপে ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু আমরা তাদের কাছ থেকে খুব কমই সহযোগিতা পাচ্ছি; যা আইপে’র ধীরগতির কারণগুলোর একটি।
আইপে সিস্টেমস লিমিটেডের ওয়েবসাইট অনুসারে, প্রাক্তন ব্যাংকার মোহাম্মদ নুরুল আমিন এ ফিনটেক কোম্পানির উপদেষ্টা। কিন্তু বাস্তবে তিনি ২০২০ সালের মার্চ থেকে কোম্পানির সাথে নেই।
যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, আমি গত বছরের মার্চ মাসে আইপে থেকে পদত্যাগ করেছি কিন্তু আমার ছবি এখনও তাদের ওয়েবসাইটে আছে যা ঠিক নয়।
তিনি বলেন, আমি যখন তাদের সাথে ছিলাম, তখন পর্যন্ত কোম্পানি ভাল কাজ করছিল, কিন্তু আমি বলতে পারছি না, কেন এটি বন্ধ হয়ে গেলো।
আইপে সিস্টেমস লিমিটেডের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, এখন কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করে লাইসেন্স দিচ্ছেন তারা, যাতে অন্য কোনো স্টার্টআপেরও আইপে’র মতো একই অবস্থা না হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বেশিরভাগ ব্যাংকই এখন তাদের গ্রাহকদের ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা প্রদানের জন্য নিজস্ব অ্যাপ বা ই-ওয়ালেট নিয়ে আসছে। এটিও আইপে’র দুর্বল ব্যবসায়িক উন্নতির আরেকটি কারণ।
অন্যান্য পেমেন্ট পরিষেবা প্রদানকারী (পিএসপি)
আইপে সিস্টেম লিমিটেডের মতো, ডি মানি বাংলাদেশ লিমিটেড আরেকটি পিএসপি অপারেটিং ব্যবসা, তবে এটি এখনও গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে পারেনি।
রিকিউসন ফিনটেক লিমিটেড এবং গ্রিন অ্যান্ড রেড টেকনোলজিস লিমিটেড- পিএসপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স পেয়েছে। কিন্তু এখনও তারা বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
প্রযুক্তি-ভিত্তিক স্টার্টআপ পাঠাও পেমেন্ট পরিষেবা প্রদানকারী হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে পাইপলাইনে রয়েছে। এছাড়া, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম চালডাল ডট কমও এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।