প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

বছরে প্রায় ১ কোটি টাকার ফল উৎপাদন করেন ড. প্রিন্স

সুলতান মাহমুদ, ময়মনসিংহ
২৮ মে ২০২২ ১৭:৫৪:৫৩ | আপডেট: ৩ years আগে
বছরে প্রায় ১ কোটি টাকার ফল উৎপাদন করেন ড. প্রিন্স

সখের বসে খামার গড়লেও এখন তা বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করছেন ড. প্রিন্স। তার খামারে উৎপাদিত ফলমূল বছরে প্রায় ২০০ মে. টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ড্রাগন ফল সবচেয়ে বেশি থাকে।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের বাবুলের বাজারে নিজের খামারে উৎপাদিত কচুর লতি বিক্রি করছিলেন আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স নামে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী এক কৃষি উদ্যোক্তা। সেই মুহুর্তের কয়েকটি ছবি তুলে রাখেন তারই কর্মচারি আল আমীন।

হৃদয় নামে আরেক কর্মচারির আইডি থেকে করা একটি পোস্ট শেয়ার করে কিষান কৃষি উদ্যোগ নামের একটি আইডিতে আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স লিখেন, ‘আজকে স্থানীয় বাজারে ১৬ কেজি কচুর লতি বিক্রি করলাম, কেজি ৫০ টাকা। বাজারের সবচেয়ে দামি সবজি এখন। পাইকার বলেছিল ৪০ টাকা, দিই নাই। তবে লতির সম্ভবত জাত পাত আছে, আরেকটু মোটা সেগুলো একটু কম। যদিও তিনজনের কাছ থেকে বাজার দামের থেকেও কম নিয়েছি, কারণ তাদের কাছে লতি কেনার তেমন টাকা ছিল না। লতিটা বিলের পাশের এলাকার একটা অভিজাত আইটেম, কারণ এখানে হরহামেশা গুঁড়া মাছ পাওয়া যায়। আইডিয়ায় নেয়া। মনে হচ্ছিল ক্ষেতে এক মণ প্রডাকশন হলেও বিক্রি হতো। এই সময় ধান কাটা কামলাদের হাতে টাকা থাকে।’

সেখানে তিনি আরও লিখেন, ‘পোস্টটি দেখার পর ছবির পাশের পিচ্চিটার জন্য মায়া লাগতেছে, বেচারার বয়স সম্ভবত পাঁচ-ছয় বছর হবে। আমাদের পাঁচ-ছয় বছর বয়সের বাচ্চাদের সঙ্গে একটু কম্পেয়ার করি।’

বিষয়টি দেখে আশ্চর্য হয়ে তাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে থাকেন অনেকে। এভাবেই মুহুর্তেই ভাইরাল হয়ে যান ড. প্রিন্স। কয়েকদিন ধরেই তার ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।

বরিশাল ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. প্রিন্স। পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করলেও কৃষিকে ভালোবাসে ২০১৪ সালে তিনি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিমি দূরে রাঙামাটিয়া ইউনিয়নে হাতিলেইট গ্রামে শ্বশুরবাড়ি এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু করেছেন। ৭ একর জমিতে গড়ে তুলতেছেন ‘কিষান সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’ নামে একটি কৃষি খামার। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে ৬ মাস ছুটি নিয়ে খামারে কৃষিকাজ করেন প্রিন্স।

তার ড্রাগন ফল বাগানে আছে তিন প্রজাতির ছয় হাজার গাছ। রয়েছে মাহালিশা, কিউজাই, ব্রুনাই কিং, বাউ-৪, কাঁচামিঠা, তাইওয়া গ্রিন, কাটিমন, পালমার, মল্লিকাসহ ১০ প্রজাতির আম, চায়না থ্রি, মঙ্গলবারিসহ তিন প্রজাতের লিচু, মিসরীয় শরিফা, স্ট্রবেরি, চেরি, থাই পেয়ারা, আম, লেবু, জাম্বুরা, লটকন, মাল্টা, সফেদা, আতাফল, কদবেল, আমলকী, ডেউয়া, ডুমুর, কাঠবাদাম, জামরুল, থাই জাম্বুরা, লটকন, মল্টা ও কলা ইত্যাদি ফলগাছ। দেশি-বিদেশি পাঁচ হাজার ফলগাছের একটি নার্সারি রয়েছে বাগানে।

প্রিন্সের বাড়ি বরিশালের ঝালকাঠির রাজাপুরে। তার বাবা ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা। বাবার চাকরির সুবাদে পরিবারসহ ঢাকায় আর্মি কলোনিতে থাকতেন। ২০০২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তারপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এআইইউবি থেকে কৃষি ব্যবসায় এমবিএ ডিগ্রি নেন ২০০৮ সালে। পরবর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হরিপদ ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট হন।

তিনি আরও বলেন, পরিকল্পিত একটি ফলের বাগান গড়তে সময় লাগে কমপক্ষে সাত থেকে আট বছর। ‘কিষান সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’ বাগানটির বয়স হয়েছে সাত বছরেরও বেশি। আমি নিজেকে এখনো সফল মনে করি না। কৃষির সফলতা আসবে তবে সেটি আস্তেধীরে। উদ্যোক্তাকে অভিজ্ঞ হবে।

ড. প্রিন্স বলেন, নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফল আবাদ আমার লক্ষ্য। বাগানে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে নিজের উৎপাদিত কেঁচো সার ও জৈব সার ব্যবহার করি। ফলগাছে পোকামাকড় নিধনে বেশি ব্যবহার করি বিভিন্ন রকমের ফাঁদ।

উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কেউ যদি ভালো কৃষি উদ্যোক্তা হয়ে চায় এবং টিকে থাকতে চায় তাকে অবশ্যই সময় দিতে হবে, নিজের পণ্য নিজেকেই বিক্রি করতে হবে। অন্যের ওপর ভরসা করে সফল হওয়া যাবে না।

ভাইরাল ছবির ব্যাপারে ড. প্রিন্স বলেন, ঈদের পর থেকে অনেক শ্রমিকই ছুটিয়ে আছে। সেজন্য আমিই স্থানীয় বাজারে ১৬ কেজি কচুর লতি নিয়ে যাই বিক্রি করতে। প্রথমে পাইকার ৪০ টাকা কেজি দরে কিনতে চেয়েছিল কিন্তু অন্যদের মতো সেখানে বসে থেকে ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছি।

ড. প্রিন্স মনে করেন, নিজের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। এতে উদ্যোক্তারা আরও অনুপ্রাণিত হবে। তরুণরা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হবে।

প্রিন্স বলেন, বছরে তার বাগানে ১০/১৫ জন শ্রমিক নিয়মিত মাসিক বেতনে কাজ করেন। এর বাইরেও দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন অনেক শ্রমিক। বছরে ৩০ লাখ টাকা শুধু শ্রমিকের বেতন চলে যায়। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ টন বিভিন্ন ধরণের ফল উৎপাদন হয় বছরে তার। ভোক্তা শ্রেণী রয়েছে তার। প্রতি কেজি ড্রাগন ফল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করেন। ভিয়েতনামি মাল্টা বিক্রি করেন ২০০ টাকা কেজি। এতে যে লাভ হয়, তা দিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছে ড. প্রিন্সের।

তিনি বলেন, তরুণ নতুন উদ্যোক্তাদের বেলায় অনেকে অর্থ সংকটে ভোগে। তখন সরকারি ঋণ পাওয়া যায় না। এটা একটা সমস্যা। যে কারণে মাঝপথে অনেকে ঝড়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণে ব্যক্তিগতভাবে একটি ফান্ড গঠন করা হবে। যেখান থেকে নতুন উদ্যোক্তারা বিনা জামানতে ঋণ পাবে। প্রিন্স বলেন, স্বপ্ন দেখি একদিন, কৃষির মাধ্যমেই দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ সুগম হবে। আমদানি নির্ভরতা কমে, রপ্তানিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, মো. তৌহিদুজ্জামান জানান, ড. প্রিন্সের মতো শিক্ষিত মানুষদের কৃষিতে যুক্ত হওয়া, আশা আলো দেখায়। এই খামারের উৎপাদিত ফলমূল জাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনের সাথে যোগ হচ্ছে। বিশেষ করে অর্গানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে নিরাপদ ফল উৎপাদন করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন তিনি। সরকারি ভাবে কোন ধরণের পরামর্শ বা সহযোগিতা চাওয়া হলে, অবশ্যই কৃষি বিভাগ থেকে তা করা হবে।

ড. প্রিন্সের খামার দেখে উদ্ভুদ্ধ হয়ে ২ একর জায়গায় খামার গড়ে তুলেছেন এলাকার আরো অনেক যুবক।

অনার্স পাশ করা রহিম নামে এক শিক্ষিত যুবক মাল্টা চাষ করছেন ড. প্রিন্সের খামার থেকে চারা নিয়ে। তিনি বলেন, প্রথমে রিস্ক মনে হলেও, তিন বছরে ১ একর জায়গায় চাষাবাদ করা হচ্ছে। সামনের বছর ফল আসবে। ভালো দামের আশা করছেন তিনি।

কৃষক সালাম কবীর বলেন, ধান চাষ করে আবার পাশের উচু পতিত জমিতে পরিকল্পিতভাবে বাণিজিক ফল বাগান করেও যে লাভ করা যায়, তা এই গ্রামে করে দেখিয়েছেন প্রিন্স স্যার। এলাকা এবং আশ পাশের বিভিন্ন জেলা থেকেও এই ফলের খামারে নতুন উদ্যোক্তারা আসেন, বাগান বিষয়ে পরামর্শ নিতে। তিনি, হাসিমুখে সবাইকে সহযোগিতা করে থাকেন।