প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

নীরব ঘাতক পোড়া তেল

রোকন উদ্দীন
০৭ মে ২০২৩ ১৫:৫০:৫৫ | আপডেট: ১ year আগে
নীরব ঘাতক পোড়া তেল

খাদ্যে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাটের অন্যতম বড় উৎস পোড়া ভোজ্য তেল বা ওয়াস্ট কুকিং ওয়েল (ডব্লিসিও), যা বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান ও হোটেল রেস্তোরাঁতে ভাজা-পোড়ার পর উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন হিসেবে দেশে এমন ক্ষতিকর তেলের উৎপাদন প্রায় ১ লাখ টনের বেশি হলেও তার মধ্যে মাত্র ২.৫-৩ হাজার টন ব্যবস্থাপনা হচ্ছে।

স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির ট্রান্সফ্যাটের অন্যতম উৎস এই তেলের অধিকাংশই কালোবাজারি হয়ে নানাভাবে পুনরায় ছোট ছোট হোটেল রেস্তোরাঁ বা ফুটপাতের খাদ্যের দোকানগুলোতে ব্যবহার হচ্ছে।

এতে নিরাপদ খাদ্য যেমন ঝুঁকিতে পড়ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়ছে। অথচ নিরাপদ খাদ্য আইন অনুসারে পোড়া তেলের পুরোটাই ফেলে দিতে হবে বা অন্য কোনো উপায়ে ব্যবস্থাপনা করার নির্দেশ রয়েছে।

এক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান ওয়াস্ট কুকিং ওয়েল কিনে বায়ো ফুয়েল তৈরি বা রপ্তানি করার উদ্যোগ নিলেও তারা বলছেন, অনেক বড় ও ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই পোড়া তেল কেনা যাচ্ছে না। কালোবাজারের সঙ্গে দামের পার্থক্য ও সচেতনতার অভাবসহ নানা সমস্যায় পড়ে প্রয়োজনীয় পোড়া তেল সংগ্রহ করতে পারছে না তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা ও খোলা তেল কেনা-বেচা বন্ধ করাসহ কিছু পদক্ষেপ নিলে ওয়াস্ট কুকিং ওয়েল পুনঃব্যবহার কমিয়ে আনা যাবে। একই সঙ্গে এই তেল বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো যাবে।

জানা যায়, হোটেলে রান্নার পোড়া ভোজ্য তেল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর হলেও যুগ যুগ ধরে এসব পোড়া তেলের পুরোটাই পুনরায় ব্যবহার করা হতো কিংবা ফেলে দেয়া হতো হোটেলের আশপাশের খোলা জায়গায়। যা মানব শরীর ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াত।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) প্রফেসর ড. মো আব্দুল আলীম দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, আমাদের ট্রান্সফ্যাট প্রতিরোধ আইন রয়েছে। এছাড়া নিরাপদ খাদ্য আইন অনুসারেও পোড়া তেল ব্যবহার নিষিদ্ধ। আইন অনুসারে পোড়া তেল ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এই ব্যবস্থাপনা বলতে এগুলোকে এমনভাবে ধ্বংস করতে হবে যাতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর না হয়। এছাড়া আরেকটি উপায় হতে পারে যারা এগুলোকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে বায়োফুয়েল তৈরি করে তাদের কাছে দিয়ে দেয়া।’

আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও দেশে যে পরিমাণ পোড়া তেল উৎপন্ন হয় তার মধ্যে খুব সামান্যই ফেলে দেয়া হয় কিংবা বায়োফুয়েল তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে যায়। অধিকাংশ তেলই বিভিন্ন হাত ঘুরে আবার ব্যবহার হচ্ছে হোটেল রেস্তোরা বা ফুটপাতের খাদ্য তৈরির দোকানগুলোতে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পোড়া তেলের সবচেয়ে বড় উৎসহ হলো চিপস, চানাচুর, বিস্কুটসহ বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদকারী বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। এছাড়া ছোট ছোট বেকারি শপ, ফাস্টফুড তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান ও হোটেল রেস্তোরাঁতেও পোড়া তেল উৎপাদন হয়।

কি পরিমাণ তেল ওয়াস্ট হয় কোনো তথ্য নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাছে না থাকলেও পোড়া তেল সংগ্রহকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বলছে, শিল্পখাতে ব্যবহৃত তেলের ২৫-৩০ শতাংশই ওয়াস্ট হয়। উন্নত দেশগুলোতে শিল্পখাতে ব্যবহৃত তেলের ওয়ান থার্ডকেই ওয়াস্ট ধরা হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ট্রেড এ্যন্ড ট্যারিফ কমিশন ও কাস্টমসের আমদানি তথ্য অনুসারে দেশে বছরে মোট ২২-২৪ লাখ টন ভোজ্য তেল ব্যবহার হয়। এর মধ্যে ৪-৫ লাখ টন ব্যবহার হয় খাদ্যপ্রক্রিয়া ও হোটেল-রেস্তোরাঁতে।

সদ্য বিলুপ্ত মালেশিয়ান পাম ওয়েল কাউন্সিলের ঢাকা অফিসের ২০২০ সালের এক গবেষণা অনুসারে দেশে খাদ্য প্রক্রিয়ায় ২ লাখ টন ও হোটেল-রেস্তোরাঁতে ২ লাখ টন মোট ৪ লাখ টন তেল শিল্পখাতে ব্যবহার হয়। সে হিসেবে দেশে ওয়াস্ট কুকিং ওয়েল (ডব্লিসিও) এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১-১.২০ লাখ টন।

এসব তেলের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সহায়তায় অস্ট্রিয়া ভিত্তিক বায়ো ডিজেল প্রস্তুতকারী কোম্পানি মুনজার বাংলা প্রাইভেট লিমিটেড ও স্থানীয় কোম্পানি বায়োটেক এনার্জি লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান মাসে বছরে ২৮০০-৩০০০ টন সংগ্রহ করতে পারছে। এছাড়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় অভিযানে গিয়ে পোড়া তেল সংগ্রহ বা জব্দ করে।

কীভাবে সংগ্রহ হয়

অস্ট্রিয়া ভিত্তিক কোম্পানি মুনজার বাংলা প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি বহুজাতিক কোম্পানি ও এ টু আই এর আর্থিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত দেশীয় প্রতিষ্ঠান বায়োটেক এনার্জি লিমিটেড রাজধানী ঢাকাসহ চারটি বিভাগ থেকে পোড়া তেল সংগ্রহ করে। এর মধ্যে মুনজার বাংলা পুরোটাই অস্ট্রিয়াতে রপ্তানি করে আর বায়োটেক কিছু তারা বায়োডিজেলের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু অংশ তারা রপ্তানি করে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে।

প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি ও বড় রেস্তোরাঁগুলোতে নিজেরা যোগাযোগ করে তাদের পোড়া তেল সংগ্রহের জন্য প্রাথমিক চুক্তিবদ্ধ হয়। এরপর তারা তাদের নির্ধারিত ড্রাম পোড়া তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দিয়ে আসে। সেগুলোতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো তেল জমিয়ে রাখে যা নির্দিষ্টসময় পর পর মুনজার বা বায়েটেক এর প্রতিনিধিরা গিয়ে নিয়ে আসে।

প্রতি কেজি ৫০-৬০ টাকা দরে তারা পোড়া তেল কিনে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তবে সবসময় এই দরে কিনতে পারেন না বলে জানান তারা।

সমস্যা কী?

মুনজার এর চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) গৌতম অভি বড়ুয়া বলেন, অনেক বড় বড় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকেও আমরা এখনও পোড়া তেল সংগ্রহ করতে পারছি না। তারা বেশি দাম পেয়ে থার্ডপার্টির কাছে বিক্রি করে দেয়। যারা নেয় তাদের অধিকাংশই আবার কোনো না কোনো রেস্তোরাঁ বা ফুটপাতের খাদ্যব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। অর্থাৎ সেগুলো আবার ভাজাপোড়ার কাজে ব্যবহার হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমাদের মূল্য সমস্যা এখন পোড়াতেলের বাড়তি দাম। যদিও পোড়া তেলের সরকারি মূল্য ৫৫ টাকা লিটার। খোলা বাজারে বা থার্ডপার্টির কাছে বিক্রি করলে ৮০-৯০ টাকা কেজি তারা বিক্রি করতে পারে। তাই চাইলেই আমাদের কাছে অনেকে বিক্রি করেনা।

রাজধানীর বেইলি রোডসহ বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতের খাদ্যের দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় ওয়াস্ট তেল ১০০-১১০ টাকা কেজি বিক্রি করতে পারেন ক্ষদ্র ব্যবসায়ীরা। তাদের এই তেলের ক্রেতা বাসার আশেপাশের দরিদ্র মানুষ।

মূল্য সমস্যার সঙ্গে বায়েটেকের উদ্যোক্তা আবদুল্লাহ আল হামিদ সচেতনতার কথাও বললেন। তিনি বলেন, আমরা তেল সংগ্রহের সময় তথ্য নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে দেখেছি খাদ্য শিল্পে ব্যবহৃত তেলের ৩০ শতাংশই ওয়াস্ট হয়। অথচ আমাদের সংগ্রহ মাসে মাত্র ১২০ টনের মতো। বাকিটা নানা কারণে সংগ্রহ করতে পারিনা।

তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা অর্থের চেয়ে মানুষের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা বেশি না করবে এবং সাধারণ ভোক্তা তার কিনে খাওয়া খাদ্যগুলো কি তেলে তৈরি হচ্ছে সে বিষয়ে সচেতন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত পোড়া তেল কালোবাজারি বন্ধ হবে না। আমরা বাড়তি দাম দিয়ে পোড়া তেল কিনে তা দিয়ে ডিজেল তৈরি করলে কস্টিং অনেক বেশি হয়, ফলে আমরা পোষাতে পারিনা।

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হোসেন সমন্বয়হীনতার কাথাও বলছেন। তিনি বলেন, পোড়া তেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এটা আমরাও জানি। কিন্তু আমাদের কাছে এমন কোন শক্তি নেই যে আমরা রেস্তোরাঁগুলোকে এসব তেল ব্যবহার না করতে বাধ্য করতে পারি। এছাড়া যখন কর্তৃপক্ষ অভিযান চালায় তখন সমিতির কোন প্রতিনিধি থাকেনা। সচেতনতামূলক কাজে আমাদেরকে কেউ ডাকেও না। এমনকি যারা তেল সংগ্রহ করছে তারাও আমাদের মালিক সমিতির কোন সহযোগীতা চায় না। ফলে কোন রেস্তোরাঁ পোড়া তেল দিতে চায় না, কেন দিতে চায় না তা আমাদের জানা নেই।