প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

বাংলাদেশের চেয়ে সিঙ্গাপুরে কম ইলিশ-মাংসের দাম

রোকন উদ্দীন, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে
০৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:২৩:০৩ | আপডেট: ১ year আগে
বাংলাদেশের চেয়ে সিঙ্গাপুরে কম ইলিশ-মাংসের দাম

বলা হয়ে থাকে সিঙ্গাপুর হচ্ছে জীবন ধারনের সবচেয়ে উচ্চ ব্যয়ের মধ্যে শীর্ষ দেশের একটি। যেখানে এক লিটার পানি পান করতে দেশি মুদ্রায় ৫০-১৬০ টাকা খরচ হয়। এমন উচ্চ খরচের দেশেও ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে।

সিঙ্গাপুরে এক কেজি ইলিশ মাছ কেনা যায় ৭.৫-১০ ডলারে বা বাংলাদেশি মুদ্রা ৬০০-৮০০ টাকায়। অথচ বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশের বাজার। সখানে এর দাম ৯০০-২০০০ টাকা কেজি। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের কেলানের লিটল ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার বাজার, সুপার শপ ও মিনিমার্টগুলো ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সিঙ্গাপুরে মায়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও মালেশিয়া থেকে মাছ, মাংস, ডিম ও শাকসবজি আমদানি হয়। এর মধ্যে সিংহভাগ মাছই আসে মায়ানমার থেকে। যেসব এলাকায় প্রবাসি বাংলাদেশি, ভারতীয় ও মায়ানমারের মানুষের সংখ্যা বেশি এসব মাছের বড় ক্রেতাই তারা। কিছু ছোট মাছ আমদানি হয় বাংলাদেশ থেকে, যা সিঙ্গাপুরে কর্মরত প্রবাসিরা বেশি দাম দিয়ে হলেও কিনে খান। এছাড়া চিকিৎসা নিতে যাওয়া ও বেড়াতে যাওয়া মানুষরাও হোটেল রেস্তোরাগুলোতে দেশি মাছ খোঁজেন। বিশেষ করে লিটল ইন্ডিয়ার মোস্তাফা সেন্টারের আশেপাশের ভারতীয় ও বাংলাদেশি প্রবাসিদের যাতায়াত বেশি হওয়ায় এখানকার মার্টগুলোতে পণ্যও রাখা হয় ক্রেতার চাহিদা অনুসারে।

হোটেল রেস্তোরাগুলোতে খাবার তৈরিও হয় ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশিসহ কয়েকটি দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের কথা মাথায় রেখেই। তাই এসব এলাকার স্টোর ও মার্টগুলোতে দেশি চাল, ডাল, মাছ, মাংস, পেয়াজ, রসুন, মসলা ও সবজিসহ প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। এমনকি ইলিশ মাছ, পাট শাক, শশাও পাওয়া যায় এসব এলাকার অনেক মিনি মার্টগুলোতে। লিটল ইন্ডিয়ার ডেসকার রোডের চীন ভিত্তিক শপ ই-হং মিনি মার্টে গিয়ে দেখা যায়, তিন পিস ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ১০ ডলারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা বিনিময় হার অনুসারে বর্তমানে সিঙ্গাপুরের ডলারের দাম ৮০.৮২ টাকা হিসেবে বাংলাদেশি টাকায় ওই ইলিশের মূল্য হয় ৮৮২ টাকা। তিন পিস ইলিশের বিভিন্ন প্যাকেট ওজন করে দেখা গেল ১.৩-১.৪ কেজি, সে হিসেবে প্রতিটি ইলিশের ওজন ৪৩৩-৪৭০ গ্রাম। এই মূল্য ও জন হিসাব করে দেখা গেলো সিঙ্গাপুরে থেকেও একজন বাংলাদেশি বা ভারতীয় প্রবাসি ইলিশ খেতে পারছে ৬৩০ টাকা কেজি দরে। ওই দোকানে কিছুটা বড় আকারের (৫০০-৭০০ গ্রাম) তিন পিস ইলিশের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ১৪ ডলার বা ১১৩১ টাকায়। সে হিসেবে এ আকারে ইলিশ মাছের কেজি দাঁড়ায় ৪৭৫-৫৪০ টাকায়।

সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এসব মাছ সরবরাহ করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের কমোডিটি কানেক্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা শাহজালাল নামে মাছ বাজারজাত করছে। এই প্রতিষ্ঠানটি ছোট ইলিশের তিন পিসের প্যাকেট ৭ ডলার ৫৬৫ টাকা ও কিছুটা বড় আকারের ইলিশের তিন পিসের প্যাকেট ১০ ডলার বা ৮১০ টাকায় সরবরাহ করে।রোববার আগোরা, স্বপ্নসহ কয়েকটি সুপারশপে গিয়ে দেখা যায় ৪০০-৪৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ৩৭৮ টাকা, সে হিসেবে ওই মানের ইলিশ কিনতে বাংলাদেশে বসে ক্রেতাকে খরচ করতে হচ্ছে কেজি প্রতি ৯৪৫ টাকা।

এসব সুপার শপে কিছুটা বড় সাইজের ইলিশ (১.২- ১.৫ কেজি ওজনের) বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ টাকা কেজি। রাজধানীর মাছের বাজারগুলোতেও খুচরায় বর্তমানে প্রায় একই দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।ই-হং মিনি মার্টে ব্যবস্থাপক শারিফুল আহমেদ বলেন, সিঙ্গাপুরে ইলিশসহ চাষের মাছগুলো মূলত আসে মায়ানমার থেকে। বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদন বেশি করলেও ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন নেই। তাই বাধ্য হয়ে মায়ানমার থেকেই আনতে হয়। ইলিশের ক্রেতা বাংলাদেশ, মায়ানমার ও ভারত এই তিন দেশের প্রবাসিরা। আমরা যে দামে ইলিশ বিক্রি করি তাতে আমাদের লস হয় না বরং প্রফিট ভালোই হয়। মাঝে মাঝে আমারা ইলিশের নানান অফার ঘোষণাও করি। অথচ বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বের ১০টি দেশের মধ্যে প্রথম, যেখানে মায়নামার তৃতীয়।

আন্তর্জাতিক মাছ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশ’র ২০১৫ সালের এক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ভারতে ১৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ইলিশ ধরা পড়ে।দেশের মাছে বড় বাধা উচ্চ মূল্য ও সার্টিফিকেট জটিলতা:বাংলাদেশ ভিত্তিক সিঙ্গাপুরের মাছ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কমোডিটি কানেক্টের ইনচার্জ সাখাওয়াত হোসেন শারিফের সঙ্গে কথা হয় সিঙ্গাপুরের বুকিত বাটোকের কোল্ডস্টোরেজের সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি বলেন, শুধু ইলিশ নয় রুই, কাতলা, বোয়াল, শোল, আইড় তেলাপিয়াসহ বড় মাছগুলোর অধিকাংশই আসে মায়ানমার থেকে। কিছু আসে পাকিস্তান ও মালেশিয়া থেকে। বাংলাদেশে থেকে এই মাছগুলো আনা সম্ভব হয় না। এর দুটি কারণ, একটি হলো মায়ানমারে এসব মাছের দাম বাংলাদেশের তুলনায় খুবই কম। ফলে বাংলাদেশ থেকে আনতে গেলে ব্যবসা করা যাবেনা। মায়ানমার থেকে মাছ আমদানি করে আমরা আমদানি খরচ, ওয়ারহাউস ভাড়া ও ডেলিভারি চার্জ বহন করার পরও মাছ বিক্রি করে মুনাফা থাকে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পাবদা মাছ মায়ানমার থেকে আনলে আমাদের প্রতি কেজিতে খরচ হয় ৬ ডলারেরও কম, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আনলে পাবদার খরচ পড়বে ১১ ডলারের বেশি।‘দ্বিতীয় কারণ সার্টিফিকেট পেতে দীর্ঘসূত্রীতা। মায়ানমার থেকে এক বা দুই দিনেই টেস্ট করে চাহিদামতো মাছ কন্টেনারে তুলে দিতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আনতে গেলে সপ্তাহ পার হয়ে যাবে, মৎস্য অধিদপ্তরের নানা জটিলতা ও কর্মকর্তাদের অসহযোগিতায় সিঙ্গাপুরের অধিকাংশ মাছ আমদানিকারক নিরুৎসাহিত হয়।’

তবে পুটি, মলা, ছোট চিংড়ি, টেংরাসহ দেশি ছোট মাছগুলো বাংলাদেশ থেকে আমদানি করি আমরা। এর কারন দেশের প্রবাসিরা এই মাছগুলো কিছুটা দাম দিয়ে হলেও কিনে খায়। ছোট দেশি মাছের প্রতি প্রবাসিদের আলাদা আকর্ষণ রয়েছে তাছাড়া এগুলোর স্বাদ মায়ানমারের মাছের তুলনায় অনেক বেশি। তাই ছোট মাছে খরচ বেশি হলেও চাহিদার কারণে বিক্রি করা যায় বলে শরিফ জানান।’

মায়ানমার থেকে আমদানি করা দুই কেজির উপরে রুই ও কাতলা মাছ সিঙ্গাপুরের মিনিমার্টগুলোতে ডেলিভারি চার্জসহ পাইকারিতে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৪.৫ ডলার বা ৩২৫-৩৬৫ টাকা কেজি। খুচরায় বিক্রি হয় ৫ ডলার বা ৪০০ টাকা কেজি। দেশের বাজারে এই আকারের রুই বিক্রি হচ্ছে ৪২০-৪৫০ টাকা কেজি।বোয়াল, শোল, আইড় মাছ পাইকারিতে বিক্রি হয় ৬-৬.৫ ডলার বা ৪৮৫-৫২৫ টাকা কেজি। খুচরায় তা ৯ ডলার বা ৭৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। দেশের বাজারে এসব মাছ বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৮০০ টাকা। পাঙ্গাস পাইকারিতে ৩ ডলার বা ২৪০ টাকা ও খুচরায় ৪ ডলার ৩২০ টাকায় বিক্রি হয় প্রতি কেজি। নদীর পাঙ্গাস হলে দাম কিছুটা বেশি, পাইকারিতে ৫ ডলার ও খুচরায় ৭ ডলারে বিক্রি হয় প্রতি কেজি।

তেলাপিয়া প্রতি কেজি ৩ ডলার পাইকারি দাম ও খুচরা ৪.৫ ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, চিংড়িসহ হিমায়িত ও টাটকা মাছের রপ্তানি থেকে আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ২১ শতাংশ কমে ৪২ কোটি ২০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।

মাংসের দামও কম

সিঙ্গাপুরের মিনিমার্টগুলোতে খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১০ ডলার বা ৮৮২ টাকা কেজি। যা বাংলাদেশে ১১০০-১৩০০ টাকা কেজি। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮ ডলার বা ৬৫০ ডাকা কেজি, দেশের বাজারে ৮০০ টাকা কেজি।