প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

বাধার মুখে ১৫ বিলিয়ন সৌদি বিনিয়োগ

০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৫:৪৫:৩৫ | আপডেট: ৩ years আগে
বাধার মুখে ১৫ বিলিয়ন সৌদি বিনিয়োগ

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ তথা গ্রিনফিল্ড এফডিআইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও করোনাভাইরাস আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাংলাদেশে ৩০টি অবকাঠামোগত প্রকল্পে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সৌদি বিনিয়োগ বাস্তবায়ন আটকে আছে। এমনটাই জানালেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ইসা ইউসুফ আলদুহাইলান।

ঢাকা দূতাবাস কার্যালয়ে দ্য বিজনেস পোস্টে’র নির্বাহী সম্পাদক নাজমুল আহসানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত। একইসঙ্গে সৌদি বিনিয়োগ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন, ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদারের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

ঢাকা-রিয়াদ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মূলত বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির উপর প্রাধান্য পেয়েছে। কেন এ দুই দেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সম্পর্ক প্রসারিত করতে পারছে না?

ইসলাম ও ভ্রাতৃত্বের নীতির ওপর ভিত্তি করে বিগত ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সৌদি আরব এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শক্তিশালী এবং স্বতন্ত্র।

বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক কেবলই জনশক্তি রপ্তানিকে ঘিরে নয়, বরং হজ্জ ও ওমরাহ ছাড়াও দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক বিষয়ের মতো একাধিক দিক রয়েছে।

বাংলাদেশে সৌদি রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার, সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ এবং বাংলাদেশ ইকোনমিক ভিশন ২০৪১ এর লক্ষ্য অর্জনে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়ে একনিষ্ঠভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বেশ কিছু সৌদি ব্যবসায়ী এর আগে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ করা হয়নি। এফডিআই আটকে থাকার নির্দিষ্ট কী কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন?

সৌদি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ একটি নতুন অর্থনৈতিক গন্তব্য, যাদের বাংলাদেশে আসার এবং বিনিয়োগ করার আকাঙ্ক্ষা-আসক্তি রয়েছে। সৌদি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা না বাড়ানোর পেছনে মহামারী করোনাভাইরাস অন্যতম কারণ হতে পারে। কারণ, এটি সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে। উৎপাদন ও উৎপাদনের হার কমেছে, অনেক কোম্পানি মার্কেট থেকেও সরে গেছে।

এছাড়াও, উভয় পক্ষের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের অভাব এবং সৌদি আরব এবং বাংলাদেশে প্রচুর বিনিয়োগের সুযোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবও বিনিয়োগ দেরী হওয়ার প্রধান কারণ।

আমরা বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছি। করোনাভাইরাস এবং বাংলাদেশের আমলাদের একাংশের কাল ক্ষেপনের মানসিকতা, প্রস্তাবিত বিনিয়োগ এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং সৌদি বিনিয়োগ এ দেশে আনার আগ্রহ এখনও বাংলাদেশের প্রতি আমাদের আগ্রহ বাড়ায়। আমি গ্রিনফিল্ড প্রস্তাবগুলো শিগগরই বাস্তবায়নের ব্যাপারে আশাবাদী।

কোভিড-১৯ সময়কালেও সৌদি আরব বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগে উদার হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আপনার অর্থনীতিতে অবদান রাখা বাংলাদেশী শ্রমিকদের আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ, তাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান; বিশেষ করে মহামারী করোনাভাইরাসের সময় তাদের বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে সৌদি আরব। কিংডমে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা এখন প্রায় ২৩ লাখ। যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বছরে ৩.৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি অবদান রাখে।

করোনা ভাইরাসের এই কঠিন সময়েও সৌদি আরব বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসা দেয়া বন্ধ করেনি, প্রতিদিন ৩ হাজার ৫০০ এর বেশি ভিসা দেয়া হচ্ছে।

সৌদ আরবে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকরা সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, সৌদি কোম্পানি ও স্থাপনার পাশাপাশি সৌদি পরিবারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কর্মীরা তাদের আন্তরিকতা, পরিশ্রম, ভালো কর্মক্ষমতা এবং বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ সম্পর্কিত প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আপনি বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন দেখছেন?

বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ এখন ভালো। এরমধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যা বিনিয়োগ এবং সামাজিক সম্প্রীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ তার ভালো যোগাযোগ, প্রতিযোগিতামূলক বাজার, ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ এবং প্রতিযোগিতামূলক খরচ কাঠামোর কারণে ভালো পরিমাণ মুনাফা দিতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক শিল্প কর্মী, কৌশলগত অবস্থান, আঞ্চলিক সংযোগ এবং বিশ্বব্যাপী প্রবেশাধিকার এবং কম শ্রম মজুরিসহ বেশকিছু বৈশিষ্টের কারণে বাংলাদেশকে এখন বিনিয়োগের আদর্শ গন্তব্য বানিয়েছে।

আমরা কিছু দেশের জন্য বেশকিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করছি, যা প্রক্রিয়াধীন। আপনি কি আপনার দেশের ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর এখানে বিনিয়োগের কোন সম্ভাবনা দেখছেন?

অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, শিল্প ও সেবা উন্নয়ন, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং বৈশ্বিক গুরুত্ব নির্ধারণে দেশের অর্থনীতির অবদান বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে, যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সেসব অঞ্চল এবং এ সংক্রান্ত আইন- যেমন, কর, শুল্ক এবং ব্যবসার ওপর অন্যান্য আইনি বিধিনিষেধ এবং বিনিয়োগের উপায় নিয়ে আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট সৌদি কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয় পাঠানো হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আমরা ইতিবাচক খবর পাবো বলে প্রত্যাশা করছি।

রোহিঙ্গাদের আগমন বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মারাত্মক আঘাত। আপনি কি নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি আমাদের ভূমিকার প্রশংসা করেন?

বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে।

আমরা এ মানবিক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করি। রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ভোগান্তি দূর করতে এবং কক্সবাজার এলাকায় জনবহুলতা কমাতে ভাসান চর দ্বীপে তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। যেখানে বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও তাদের যথাযথ জীবনযাত্রার সু ব্যবস্থা করা হয়েছে। কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থা এবং করোনাভাইরাস মহামারীর অবস্থার মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের জনগণের আতিথেয়তার এ মহৎ কাজ প্রশংসনীয়।

ওআইসি এখন পর্যন্ত সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সাধারণ বাজার এবং এফটিএ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সৌদি আরবকে অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে চায় বাংলাদেশ। আপনার সরকারের কী কোনো পরিকল্পনা আছে?

ইসলামী দেশগুলোর সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে সব ধরনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে সৌদি আরব। একটি সাধারণ ইসলামী বাজার প্রতিষ্ঠা, উৎপাদন ক্ষেত্র সম্প্রসারণ, তরুণদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ, পণ্য রপ্তানি এবং প্রতিটি দেশের তুলনামূলক সুবিধা থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে।

এখানে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠা, দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক চুক্তি সক্রিয়করণ, আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কেমন, তা অধ্যয়ন জরুরি।

মাননীয় বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ দুটি পবিত্র মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদি আরবকে অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে আগ্রহী। এ বিষয়ে আপনার বাংলাদেশি ভাই-বোনদের জন্য কোন বার্তা আছে?

বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের নেতৃত্বে (আল্লাহ তাকে রক্ষা করুন) সৌদি আরব দুটি পবিত্র মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক। ইসলামী দেশ ও জনগণের মধ্যে এটি একটি উচ্চ স্থান অধিকার করে। কারণ, এটি দুটি পবিত্র মসজিদের ভূমি এবং মুসলমানদের কিবলা।

সৌদি আরব বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় প্রধান ভূমিকা পালন করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও অভাবী মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। একইসঙ্গে মানবিক ও ত্রাণ সহায়তার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখে।

ইসলামী জাতির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে সৌদি আরব। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সৌদি আরব। কারণ এটি জি-২০ এর সদস্য এবং আরব ও ইসলামী বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে।

সৌদি আরব তেলের বৃহত্তম রপ্তানিকারক হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবদান রাখে এবং বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। এছাড়াও, সৌদি আরবের কৌশলগত অবস্থান মহাদেশগুলোকে সংযুক্ত করার একটি অঞ্চল হিসেবেও অনুমোদন দেয়।

দুটি পবিত্র মসজিদের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে যখন আমি দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলাম, তখন তিনি বাংলাদেশী নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন।

তিনি দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ ও জনগণের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উচ্চস্থানে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। যা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃশ্যমান।