প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম

বিশ্ববাজারে কমলেও দেশের বাজার চড়া

রোকন উদ্দীন
২৪ আগস্ট ২০২২ ১৭:৫৬:২০ | আপডেট: ২ years আগে
বিশ্ববাজারে কমলেও দেশের বাজার চড়া

যখন দেশের বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম এক মাসের ব্যবধানে দুই দফায় বেড়ে রেকর্ড ১৮৫ টাকা লিটারে উঠেছিলো তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি টন ১৯৩৬ মার্কিন ডলার। তবে গত মে মাসের শেষে তেলের দাম কমতে থাকে।

গত তিন মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২৬ শতাংশ কমে ১৪৩০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু দেশের বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে প্রায় আগের দামেই। বর্তমানে খোলা সয়াবিন তেল ১৮২ টাকা লিটার।একই ভাবে মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়ে প্রতি বুশেল ১২৯৪ মার্কিন ডলারে উঠে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দেশের বাজারে প্রতি কেজি আটার দাম এক লাফে ৩০ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকায় উঠেছিল। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিবুশেল গমের দাম আবার ৪০ শতাংশ কমে ৭৭৫ ডলারে নেমে এসেছে। তবে দেশের বাজারে কমেনি আটার দাম। খুচরা বাজারে খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি।

শুধু তেল ও আটা নয় আমদানি করে দেশের চাহিদা পূরণ হয় এমন অনেক খাদ্যপণ্যই রয়েছে সেগুলোর দাম বিশ্ববাজারে কমলেও দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে কমেনি, বরং বেড়েছে । ফলে দেশের ভোক্তারা বাড়তি দামের চাপ সইলেও হ্রাসকৃত দামের স্বস্তি পাচ্ছেনা। তারা এখনও জানেনা কবে খাদ্যপণ্যের এই লাগামহীন বাড়তি দাম কমতে শুরু করবে এবং জীবন যাত্রার ব্যয়ের চাপ কমবে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, এমনিতেই আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের কালচার হলো যখন আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ে তখন সাথে সাথে দেশের বাজারেও বাড়িয়ে দেন। কিন্তু যখন কমে তখন নানা অজুহাতে বাড়তি দাম ধরে রাখেন। এখন সেই সেই কালচারের সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলারের বাড়তি দামের অজুহাত। যদিও এটা বাস্তবতা যেডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানির সবখরচই বেড়েছে। কিন্তু ডলারের দাম কম হলেও মনে হয়না দাম সহসাইকমতো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে গত দুই থেকে তিন মাস ধরে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল, গম, ভুট্টা, দুধ ও মাংসসহ প্রায় সবধরনের খাদ্যপণ্যের দামই কমছে। বৈশ্বিক পণ্যমূল্য নিয়ে এফওওর তৈরি করা খাদ্য মূল্যসূচক (এফপিআই) জুলাই মাসে আগের মাসের তুলনায় ৮ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। তার আগের মাস জুনে এই সূচক কমেছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

এফএওর মূল্যসূচক অনুযায়ী জুলাই মাসে প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর দাম গড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে বিশেষ করে গমের দাম ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। সংস্থাটির মতে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার শস্য চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় ও পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে এবার ভালো ফসল হওয়ায় গমের দাম বেশি কমেছে।

ভোজ্যতেলের বাজারে লাগাম পড়েছে পাম তেলের বৃহত্তম উৎপাদক ইন্দোনেশিয়া থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে রপ্তানি হওয়ার সুবাদে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সূর্যমুখী তেলের চাহিদা কমার কারণে ভোজ্যতেলের দাম ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমে গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।

একদিকে চাহিদা সংকুচিত হওয়ায় অন্যদিকে প্রধান দুই উৎপাদক ও রপ্তানিকারক ব্রাজিল ও ভারত থেকে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আলোচ্য মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ৩ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। এতে চিনির দাম এখন গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া দুগ্ধপণ্য ও মাংসের দামও কমেছে। পণ্য দুটির দাম কমেছে যথাক্রমে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।

তবে আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও ডলারের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই সুফল পাচ্ছেনা দেশের মানুষ। এছাড়া হ্রাসকৃত মূল্যের পণ্য এখনও দেশে এসে পৌছেনি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার কমলেও দেশের বাজারে কমেনি। তারা বলছেন, দেশের বাজারে ডলারের দাম কমলে এবং হ্রাসকৃত মূল্যের পণ্য দেশে এসে পৌঁছলে দাম কমতে পারে।

তবে অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, শুধু মাত্র ডলারের দাম কমলেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারেও পণ্যমূল্য কমে যেত। কারণ অনেকে আগের বাড়তি দামের মজুদ পণ্য বিক্রি করে হ্রাসকৃত দামের পণ্যের আমদানির জন্য এলসি খুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।

খাদ্য পণ্যের অন্যতম আমদানিকারক ও বাজারজাকারী টিকে গ্রুপের পরিচালক (ব্র্যান্ড এ্যান্ড ফাইনান্স) শফিউল আতহার তসলিম বিজনেসর পোস্টকে বলেন, প্রতিযোগীতাশীল এই বাজারে সাধারণত আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে লোকাল মার্কেটেও দাম কমে আসে। কারণ লোকসানের ভয়ে অনেকে পণ্য দ্রুত বিক্রি করতে চান। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমেছে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কিন্তু ডলারের দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল আমরা আমদানিকারকরাই পাচ্ছি না। তিনি বলেন, এখনও আমাদের যে ভোজ্য তেল বন্দরে এসে পৌছেতেছে তা প্রতিটন ১৮০০ ডলার মূল্যে কেনা। যদিও এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ১৪৫০-১৫০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। বিপরীতে ৮৬ টাকার ডলার কিনতে হচ্ছে ১১৫ টাকা দিয়ে। শুধু তেল নয় সব পণ্যের ক্ষেত্রে একই চিত্র। কম হ্রাসকৃত পণ্য দেশে এসে পৌঁছলে এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল হলে বাজার তার নিজস্ব গতিতেই নেমে যাবে।