প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

ব্র্যান্ডের ভিড়েও চাহিদা বাড়ছে ঘানি সরিষার তেলের

০৩ নভেম্বর ২০২১ ১৫:২৭:৩৪ | আপডেট: ৩ years আগে
ব্র্যান্ডের ভিড়েও চাহিদা বাড়ছে ঘানি সরিষার তেলের

মোহাম্মদ নাহিয়ান

বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সরিষার তেল থাকা সত্ত্বেও ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে ষাঁড় দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘানিতে উৎপাদিত কারখানাগুলো এখন তাদের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।

সরিষার তেল উৎপাদনের দেশীয় একটি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি ঘানি। এক সময় ঘানি কলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে থাকলেও বড় বিনিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি আর কর্পোরেট ব্যবসার কারণে এটি এখন তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

তবে, পুরনো এ তেল কলগুলো দেশের কয়েকটি অঞ্চলে টিকে থাকার লড়াই করছে। কিছু মানুষ এখনও তাদের পৈতৃক ব্যবসা ধরে রাখতে চাইছেন।

মুদি দোকানগুলোতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সরিষার তেল পাওয়া গেলেও বিশুদ্ধতার বিবেচনায় স্বাস্থ্য-সচেতন ভোক্তারা ঘানি ভাঙা সরিষার তেলই বেশি পছন্দ করেন।

দ্য বিজনেস পোস্ট-এর সাথে আলাপকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো: খুরশিদুল জাহিদ বলেন, যদি ঘানি ভাঙা তেল উৎপাদনকারীরা পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই তা সবসময়ই ভোক্তাদের জন্য ভালো হবে।

তিনি বলেন, আরও ভালো মানের ঘানি ভাঙা সরিষার তেল পেতে কর্তৃপক্ষকে এসব মিলের ওপর নজরদারি করা উচিত। সেইসাথে মিল মালিকরা তেলের সাথে কোনও রাসায়নিক মেশাচ্ছেন কি না, তাও দেখা উচিত।

দেশীয় সরিষার তেলের ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রাঁধুনী, তীর, ফ্রেশ বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে। এছাড়া নন-ব্র্যান্ড সরিষার তেলও পাওয়া যায়।

১ লিটার রাধুনি ব্র্যান্ডের তেল বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকায়, এক লিটার ফ্রেশ সরিষার তেল ২৫৫ টাকায় এবং তীর ব্র্যান্ডের একই পরিমাণ তেল বিক্রি হচ্ছে ২৩৫ টাকায়।

উন্নত প্রযুক্তির আধুনিক যুগে ঘানি’র সরিষার তেল দেশের প্রধান শহরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায় না। যদিও সচেতন গ্রাহকদের একটি বড় অংশ এখনও এটির সন্ধান করেন, বিশেষ করে এর স্বাদ এবং গন্ধের জন্য।

এ কারণেই ঘানি সরিষার তেল এখনও জনপ্রিয়। বিপুল বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর বিপরীতে লড়াই করে এখনও টিকে আছে।

কীভাবে ঘানি সরিষার তেল উৎপাদন হয়?

সাধারণত, প্রশিক্ষিত গরু কাঠের নিষ্কাশন মেশিনের চারপাশে ঘোরার সময় তাদের মাথা ঘোরা এবং বিভ্রান্তি এড়াতে চোখ বাঁধা থাকে। এভাবে তৈলবীজগুলো (সরিষা) প্রক্রিয়া করা হয়, যা বেশ সময়সাপেক্ষও।

দ্য বিজনেস পোস্ট-এর সাথে আলাপকালে, সাভারের মারজান অয়েল মিলের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মমিন বলেন, আমি ২০০৯ সাল থেকে ঐতিহ্যবাহী ঘানি তেল শোধনাগার ব্যবসার সাথে জড়িত। কারণ, আমার পূর্ব পুরুষেরা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এর সাথে জড়িত।

তিনি বলেন, বাজারে ব্র্যান্ডের সরিষার তেলের ব্যাপক সরবরাহ থাকলেও এখনও কিছু স্বাস্থ্য-সচেতন গ্রাহক আমাদের কাছ থেকে ঘানি তেল কিনতে পছন্দ করেন, যদিও আমাদের পণ্যের দাম ব্র্যান্ডের তেলের চেয়ে বেশি।

মমিন বলেন, সারা দেশে ঘানি তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার থাকায় আমার কোম্পানির পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, পাবনা, ফেনী, ময়মনসিংহ এবং বরিশালসহ সারা দেশে অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছি। এ মুহূর্তে, আমার পণ্য ইউএসবি এক্সপ্রেস এবং এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে।

সাভার এলাকায় মোট ৪টি ঘানি সরিষার তেলের কারখানা চালু রয়েছে।

সাভার ছাড়াও, ঐতিহ্যবাহী এ তেল কারখানাগুলো মূলত পাবনা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও এবং আরও কয়েকটি জায়গায় রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, পাকিস্তান আমল এবং মুক্তিযুদ্ধের পরেও সরিষার তেলের একমাত্র উৎস ছিল ঐতিহ্যবাহী ঘানি বা গরুর দ্বারা চালিত তেল মিল।

এ ধরনের মিল মালিকদের কোনো অ্যাসোসিয়েশন বা ফোরাম না থাকায় এ খাতের সঠিক বাজারের আকার বা বৃদ্ধির হার সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।

এ সেক্টর সংশ্লিষ্টদের দাবি, গত কয়েক বছরে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় সারাদেশে ঘানি তেলের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে।

তারা সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে ঘানি সরিষার তেল উৎপাদনকারীদের নীতিগত সহায়তার পাশাপাশি নির্দেশনা বেধে দেয়ার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

খায়রুল ইসলাম নামে একজন গ্রাহক বলেন, আমি সবসময় অন্য ব্র্যান্ডের ভোজ্য তেলের চেয়ে ঘানি সরিষার তেল বেশি কিনি। কারণ, এটি খুবই বিশুদ্ধ এবং আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। সাধারণ সরিষার তেল ও সয়াবিন তেলের তুলনায় ঘানি তেলের দাম তুলনামূলক বেশি।

খায়রুলের মতো অন্যান্য গ্রাহকও দাবি করেন, ঘানি তেল আসল স্বাদের কারণে এখনও একটি জনপ্রিয় রান্নার উপাদান। এছাড়াও, এটি চুল এবং ত্বকের যত্নেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

তারা মনে করেন, মেশিনে উৎপাদিত ব্র্যান্ডের তেল ব্যবহারের পরিবর্তে যদি ঘানি সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়, তাহলে ঐতিহ্যবাহী এ পদ্ধতিটি পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।

মর্ডর ইন্টেলিজেন্সের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালে বাংলাদেশের সরিষার তেলের বাজার ৫.৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হয়।

বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের বাজারের প্রায় ৫-৬ শতাংশ অংশ এখন সরিষার তেলের দখলে বলেও ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।