প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

ভূয়া কোম্পানিকে এবি ব্যাংকের ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ

দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ বিএফআইইউর
মেহেদী হাসান
২৪ মে ২০২৩ ১৬:২৮:১৪ | আপডেট: ২ years আগে
ভূয়া কোম্পানিকে এবি ব্যাংকের ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ

ব্যাংকিং নিয়ম ও প্রবিধান লঙ্ঘন করে ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং লিমিটেড নামে একটি নামসর্বস্ব কোম্পানিকে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে দেশের প্রথম বেসরকারি খাতের ব্যাংক এবি ব্যাংক।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর তদন্তে এ তথ্য পাওয়া যায়।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ঋণের আবেদন জমা দেওয়ার সময় ব্যাংকের গুলশান শাখার ম্যানেজার ও অন্যান্য কর্মকর্তারা একটি ভুয়া অডিট রিপোর্ট দাখিল করে ব্র্যান্ডশেয়ারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেতে সহায়তা করেন।

দ্য বিজনেস পোস্ট এ প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পেয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণগুলো গত ৯ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন করা হয়।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদ এবং ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মোহাম্মদ আলী হায়দার রতনের পারস্পরিক যোগসাজশে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে এ ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী হলেন রতন তবে ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিংয়ের নিবন্ধন এবং ট্রেড লাইসেন্স মো. আতাউর রহমান এবং মো. মামুনুর রশীদের নাম ব্যবহার করে করা হয়েছে।

বিএফআইইউর তদন্তে দেখা গেছে, ব্র্যান্ডশেয়ার একটি নামসর্বস্ব কোম্পানি এবং এটি শুধুমাত্র কাগজে কলমে বিদ্যমান। এছাড়া ব্র্যান্ডশেয়ার এবং রতনের মধ্যে কোনও সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবে কোম্পানিটি দৃশ্যত ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের ভাড়া করা অফিসের ভিতরে ৩০০ বর্গফুট জায়গায় অবস্থিত।

অন্যদিকে, আলোচ্য ঋণটির আবেদন থেকে শুরু করে সহায়ক জামানত, পার্সোনাল ও করপোরেট গ্যারান্টি প্রদানসহ যাবতীয় কার্যসম্পাদন করেছেন আলী হায়দার রতন নিজেই।

এ বিষয়ে দ্য বিজনেস পোস্ট সংবাদদাতা ফোনে ইনফ্রাটেকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোম্পানির কেউ কল রিসিভ করেননি।

বিএফআইইউ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানি, রপ্তানি ও সরবরাহকারী হিসেবে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্ম (আরজেএসসি) থেকে ২০২২ সালের ৯ জুন ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিংয়ের নিবন্ধন নেয়া হয়। একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। তবে ব্র্যান্ডশেয়ার কোম্পানিটি নিবন্ধিত হওয়ার পর থেকে কোনো আমদানি বা রপ্তানি ব্যবসা করেনি। কিন্তু এবি ব্যাংকের ক্রেডিট বিভাগ ঋণের আবেদনে প্রকৃত তথ্য উল্লেখ করেনি এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কোনো প্রশ্ন তোলেনি।

তদন্তের পর গত ২৫ এপ্রিল এ বিষয়ে এবি ব্যাংকের এমডিকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয় এবং ব্র্যান্ডশেয়ার কোম্পানিটিকে ঋণ বিতরণ স্থগিত করার নির্দেশ দেয় বিএফআইইউ। এছাড়াও সংস্থাটির পক্ষ থেকে ১৮ মে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) এবি ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

ভিত্তিহীন তথ্য

এ বিষয়ে এবি ব্যাংকের সভাপতি ও এমডি তারিক আফজাল দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের পরিচালনা পর্ষদ যখন ঋণ অনুমোদন করে তখন আমি ছুটিতে ছিলাম। তবে আমরা ঋণ বিতরণ স্থগিত করেছি। একই সাথে বিএফআইইউর আদেশ অনুসরণ করে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোও জব্দ করেছি।’

তিনি আরও বলেন, বিএফআইইউ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পরিদর্শন বিভাগ তদন্ত করেছে। তবে আমরা কোনো অন্যায় করিনি। আমরা যদি করে থাকি, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো আমাদের শাস্তি দেয়নি কেন?

ব্র্যান্ডশেয়ার সম্পর্কে জানতে চাইলে তারেক দাবি করেন, এটি কোনো ভুয়া কোম্পানি নয়। ‘এটি ভিত্তিহীন তথ্য।’

আরও একটি অনিয়ম

বিএফআইইউ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এবি ব্যাংক ঋণ অনুমোদনের কাগজে শর্তাবলী লঙ্ঘন করে এবং কার্যাদেশের ছাড়াই রতনের ইনফ্রাটেককে ১৬.১৩ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারিক দাবি করেন, ‘আমরা কোম্পানির মাধ্যমে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) পারফরম্যান্স গ্যারান্টি দিয়েছিলাম। ঋণ সুবিধার বিপরীতে আমাদের পর্যাপ্ত জামানত রয়েছে।’

তবে বিএফআইইউ রিপোর্টে র‌্যাবের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি পাওয়ার কথা উল্লেখ নেই।

বিএফআইইউ ১৬ মার্চ এবি ব্যাংককে রতন এবং তার কোম্পানি ইনফ্রাটেক এবং ব্র্যান্ডউইন গ্রুপের সমস্ত ঋণ-সম্পর্কিত কার্যক্রম এবং অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার নির্দেশ দেয়।

যেখানে উল্লেখ করা হয়, নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের বাসিন্দা আলী হায়দার রতন ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডার এবং একই বন্ধক ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

এবি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে এবি ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ১৩ কোটি টাকা, যারমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের ১২.৮৯ শতাংশ।

এবি ব্যাংক, যা আরব বাংলাদেশ ব্যাংক নামে পরিচিত, ১৯৮২ সালের ১২ এপ্রিলে কার্যকরী কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে এটির সারা দেশে ১০৪টি শাখা রয়েছে এবং ভারতের মুম্বাইতে একটি বিদেশী শাখা রয়েছে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটি তার পরিচালক পদে একটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময় ব্যাংকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের মধ্যে তৎকালীন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক সহ একজন ভাইস চেয়ারম্যান এবং একজন পরিচালক ব্যাংকের বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন।