বর্তমান ভূ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিদ্যমান এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের অর্থনীতির যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মোঃ সামীর সাত্তার।
বৃহস্পতিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারিখাতের দৃষ্টিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২) বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)’র সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহসিনা ইয়াসমিন ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
ডিসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার মোঃ সামীর সাত্তার উক্ত সেমিনারে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটের উপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে তিনি স্থানীয় অর্থনীতিতে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব, এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ, জাতীয় বাজেট ও মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, কৃষি, উৎপাদন ও সেবা খাত নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন।
এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী সময়ে রপ্তানি সম্প্রসারণে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং সম্ভাবনাময় দেশ ও আঞ্চলিক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাথে পিটিএ ও এফটিএ স্বাক্ষর তরান্বিতকরণ, ব্যবসা-বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিকরণ, মুদ্রানীতির যথাযথ বাস্তবায়ন, বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় সংষ্কারসহ প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের উপর জোর দেন ডিসিসিআই সভাপতি।
তিনি বলেন, খেলাপী ঋণ কমাতে সুশাসন নিশ্চিকরনের সাথে সাথে কঠোর নজরদারির কোন বিকল্প নেই।
এছাড়াও বৈদেশিক বিনিয়োগে বহুমুখীকরণ, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের ভ্যালু এ্যাডিশন ৯০ শতাংশে উন্নীতকরণ, ঔষধ শিল্পের জন্য এপিআই শিল্পপার্কের দ্রুত বাস্তবায়ন, হালকা-প্রকৌশল শিল্পের জন্য পৃথক শিল্পাঞ্চল এবং পাট পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য নগদ সহায়তার প্রস্তাব করেন তিনি।
কৃষি খাতের আধুনিকায়ন ও কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের উপর আরও বেশি হারে গুরুত্বারোপের পাশাপাশি বিশেষকরে এখাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৃদ্ধিকল্পে কমপক্ষে ১টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ দেওয়ার আহ্বান জানান ব্যারিস্টার সাত্তার।
চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স অনুসরণ, হালকা প্রকৌশল খাতে দক্ষতা উন্নয়ন ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়াতে শিক্ষাকার্যক্রমের আধুনিকায়নের পাশাপাশি কারিগরী শিক্ষায় আরও বেশি হারে জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি।
সিএমএসএমই হতে ‘মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ’কে পৃথকীকরণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তারা আরও সহজে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তিতে সক্ষম হবে।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এলডিসি উত্তরণ নিয়ে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তবে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে, বিশেষ করে এলডিসি পরবর্তী সময়ে রপ্তানি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে ভ্যালু এডিশনের উপর আরও বেশি হারে জোর দিতে হবে। এ লক্ষ্যে বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতে দক্ষতা বৃদ্ধিতে আরও বেশি হারে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। সেই সাথে এলডিসি পরবর্তী সময়ে রপ্তানির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্ভাবনাময় রপ্তানিমুখী পণ্যের বহুমুখীকরণ একান্ত অপরিহার্য।
তিনি বলেন, মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে দেশের শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন অতীব জরুরী। বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রপান্তরে সরকারের একক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন সরকার ও বেসরকারি খাতের কার্যকর সমন্বয়।
বিডা’র সচিব মোহসিনা ইয়াসমিন বলেন, বিডা’র ওয়ান স্টপ পোর্টালের মাধ্যমে বর্তমানে ১৮টি সেবা অনলাইনে প্রদান করা হচ্ছে এবং আগামীতে ৪০টি সংস্থার প্রায় ১৫০টি সেবা এ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রদান করা হবে। আমাদের উদ্যোক্তাদের এ ধরনের সেবা গ্রহণের হার খুবই কম। ফলে সেবা প্রাপ্তিতে কোন ধরনের সমস্যা থাকলে তা নিরসনে বিডা কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছেনা।
তিনি উদ্যোক্তাদের বিডা পোর্টাল ব্যবহার করে অনলাইন ভিত্তিক সেবা গ্রহণের বাড়ানোর জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
শুধুমাত্র মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিই উন্নয়নের একমাত্র পরিমাপক নয়, আমাদেরকে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। বৈশ্বিক ও স্থানীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের অর্থনীতি কতটা সক্ষম তা নির্ধারণে নিজেদের হোমওয়ার্ক অতীব জরুরী বলে জানিয়েছেন সানেম’র নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ সংকট, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা প্রভৃতি সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়গুলো আমাদের সামাজিক খাত বিশেষকরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব ফেলেছে, যা মোকবেলায় সকলকে আরো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গুলো আমাদের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, তাই সকল সেবার অন্তভূক্তির মাধ্যমে যথাসময়ে এগুলোর কার্যক্রম শুরু করার প্রতি সরকারকে আরো মনোযোগী হতে হবে বলেও জানান তিনি।
মিউচুয়্যাল ট্রাষ্ট ব্যাংক’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আর্থিক খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ খুবই জরুরী। এ ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির উপর আরো বেশি হারে জোরারোপ করতে হবে।
খেলাপী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্থবিরতা আসবে, যা বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি সহ সর্বপোরি জনজীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং খেলাপী ঋণ হ্রাসে তিনি রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা এবং খেলাপী ঋণের সাথে সম্পৃক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানান।
পিএইচপি ফ্যামিলি’র পরিচালক মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, আমাদের বেসরকারিখাতের উদ্যোক্তারা অত্যন্ত উদ্যোমী, তবে প্রয়োজন সরকারের যথাযথ নীতি সহায়তা।
এছাড়াও ঘন ঘন শুল্ক বিধিমালা পরিবর্তন না করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।