প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

মূল্যস্ফীতি: শখের পণ্যে বিমুখ ক্রেতা

আফরিন আপ্পি
২৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:১৫:০০ | আপডেট: ২ years আগে
মূল্যস্ফীতি: শখের পণ্যে বিমুখ ক্রেতা

ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী থাকা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যয়। ফলে কমছে জীবনযাত্রার মান। কাটছাট হচ্ছে সংসারের বাজেট। জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম অবস্থা। সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সৌখিন জিনিস থেকে। ক্রেতা হারিয়ে বন্ধ হতে বসেছে অনেক দোকান। অনেকে আবার গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসা। এ পরিস্থিতি-ই জানান দিচ্ছে ‘শখের দাম লাখ টাকা’ এ কথা এখন শুধু লোকমুখেই সীমাবদ্ধ।

চলতে হয় হিসেব করে

মালিবাগের একটি মেসে থাকেন বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত মাহমুদ। থাকা-খাওয়া বাবদ আগে প্রতি মাসে তার সাড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ হলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার টাকায়।

মাহমুদ জানান, আগে ইচ্ছে হলেই শখের জিনিস কিনতে পারতেন। কিন্তু মাসের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন হিসেব করে কিনতে হয়। যে জিনিসটা এ মাসে কেনা প্রয়োজন সেটি টাকা জমিয়ে দুই থেকে তিন মাস পর কিনছেন।

মাহমুদের ভাষায়, আমার একটি কম্পিউটারের ইউপিএস কেনা খুব জরুরী ছিলো ৩ মাস আগে। আমি সেটি গত সপ্তাহে কিনেছি। এটার দাম আগে ২ হাজার ১০০ টাকা ছিলো; আমি ২ হাজার ৯০০ টাকায় কিনেছি।

কফি খেতে ভীষণ পছন্দ করেন আনিস রহমান। তার পছন্দের কফিটির দাম আগে ছিলো ২৫টাকা। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ৪০ টাকা। বাধ্য হয়েই তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন সেই কফি। আগে প্রতি সপ্তাহে বাড়ি ফেরার সময় মায়ের জন্য দুই কেজি দই আর ১ কেজি আনার নিয়ে যেতেন তিনি। কিন্তু গত কয়েকমাস যাবত মায়ের জন্য ১ কেজি দই আর হাফ কেজি আনার নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে আর নিতে পারবেন কিনা সে বিষয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই গণমাধ্যমকর্মী।

শখের জিনিস এখন আর কেনা হয় না বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ী কাজী মাহবুব। তিনি বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় এখন দ্বিগুণ হয়েছে। এ কারণে শখের কেনাকাটা অনেকটাই কমেছে। মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খাচ্ছি। সৌখিন জিনিসের দিকে মনোযোগ দিতে পারছি না। বাড়ি ঘর সাজানোর জন্য সৌন্দর্যবর্ধনের জিনিস আগে প্রতি মাসেই কিনতাম। কিন্তু আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না হওয়ায় এখন আর কিনি না।’

প্রতি মাসে নিজের জন্য ১ থেকে ২টি টি-শার্ট কিনতেন শাহীন। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের  উর্ধ্বগতির কারণে প্রতি ৩ মাস অন্তর কিনছেন ১টি করে। এই প্রকৌশলী বলেন, ‘সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে প্রায় শতভাগ। আগে অফিস থেকে বাসায় যেতে খরচ হতো ২০ টাকা। আর এখন খরচ হয় ৪০টাকা। এসব কারণে এখন আর শখ পূরণ করতে ইচ্ছে করে না।’

ব্যবসা গুটাচ্ছেন উদ্যোক্তারা

এসব কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় উদ্যোক্তাদের কণ্ঠে। ২০২০ সাল থেকে ফেসবুকে ‘গয়নার গল্প’ নামে একটি পেজ চালান নিলুফার ইয়াসমিন নিলা। মূল্যস্ফীতির কারণে তার এ ব্যবসায় ভাটা পড়েছে।

দ্য বিজনেস পোস্ট’কে তিনি বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লেও সেগুলো আমাদের জন্য অপরিহার্য। চাইলেই আমরা সেখান থেকে বাজেট কমাতে পারি না।’

‘যেহেতু আমি গয়না বিক্রি করি। আর এটি সৌখিন জিনিস হওয়ায় এর উপরে প্রভাব পড়ছে। আমার নিয়মিত কিছু ক্রেতা রয়েছেন; যারা আগে প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪ বার অর্ডার করতেন। তারা এখন কোনো কোনো মাসে অর্ডারও করছেন না। বিক্রি আগের থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে।’

অনেক বড় বড় ফেসবুক পেজের সত্ত্বাধিকারীরাই এখন ব্যবসা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের অনেকেই ফেসবুক পেজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

এ বিষয়ে অনলাইনে পাটজাত পণ্য বিক্রিয়কারী শপ ‘ডু’ এর সত্ত্বাধিকারী এনায়েতুল ইসলাম নাঈম বলেন, বর্তমানে আমাদের ব্যবসা খুব খারাপ যাচ্ছে। আগের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কমেছে বিক্রি। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও বায়াররা আর পণ্য নিতে চাইছেন না। আমাদের বাণিজ্য মূলত অনলাইন ও মেলা কেন্দ্রিক। কিন্তু বর্তমানে মেলার আয়োজন হচ্ছে না।

অনলাইন কেনাকাটায় ঝোঁক থাকলেও সবকিছুর দাম বাড়ায় ক্রেতারা  শখ পূরণের বিষয়গুলো এড়িয়ে চলছেন উল্লেখ করে এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘কাঁচামালের দাম বেশি হলেও বিক্রির সময় ক্রেতারা বেশি দামে পণ্য নিতে চান না। সামগ্রিকভাবে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা।’

মূল্যস্ফীতির বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিলো ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এটি জুলাইয়ে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ।

চলতি বছরের আগস্টে বিগত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিলো। আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে।

কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা?

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে সমাজে তিন শ্রেণি বাস করে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। যদি মূল্যস্ফিতীর কথা বলি; তাহলে এই তিন শ্রেণির প্রভাব ভিন্ন।

নিম্নবিত্ত যারা তাদের আয় নির্দিষ্ট থাকে। তারা দিন আনে দিন খায়। মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের খাদ্য সংস্থানই হুমকির মুখে পড়বে।

মধ্যবিত্ত যারা; তারা এখন আর লাক্সারি পণ্য কিনছে না। দেখা যাচ্ছে, যারা আগে প্রতি মাসে একটা বেডশিট কিনতো, শোপিস কিনতো, ঘর সাজানোর নানা উপকরণ কিংবা পোশাক কিনতো। এখন তারা বছরে ১ বার এসব পণ্য কিনছে।

উচ্চবিত্ত যারা তাদের আয় এত বেশি যে মূল্যস্ফীতি তাদের জীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। তবে তাদের জীবনে যে প্রভাব দেখা গেছে তা সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিলাসবহুল পণ্য ক্রয়ে এলসি খোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। ফলে দেখা যাচ্ছে, একটি গাড়ির দাম ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু উচ্চবিত্ত ওই ব্যক্তি এ বাবদ ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখেও নিষেধাজ্ঞা থাকায় তার শখ পূরণ করতে পারছেন না।’

মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সার্বিকভাবেই ব্যহত করে তবে প্রভাবটা ভিন্ন হয়। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। ফলে, যে মানুষগুলোকে আমরা অদরিদ্র বলি তারাও এখন দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ।