ডলার সংকটের মাঝেও সরকারের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর কয়েকটি সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে অন্যতম বড় সম্ভাবনা হচ্ছে, করোনার পর জনশক্তি রপ্তানির যে জোয়ার বইছে তা কাজে লাগানো।
নতুন অভিবাসীরা যাতে বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহী হয়, সেজন্য খোলার বাজার ও আন্ত:ব্যাংক বিনিময়হার এর ব্যবধান যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে এবং প্রণোদনার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
এছাড়া জনশক্তি রপ্তানির এই জোয়ার ধরে রাখার জন্য, বর্তমান ডলার সংকটকে মাথায় রেখে অভিবাসন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি, রপ্তানি পণ্যের মূল্য ও দেশে আসা রপ্তানি আয়ের মধ্যে যে বড় ফারাক তৈরি হয়েছে তা কমিয়ে আনতে হবে।
অন্যদিকে, বিলাসবহুল পণ্য আমদানি হ্রাস করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাজস্ব বোর্ড যেসব উদ্যোগ নিয়ে তা অব্যাহত রাখা এবং সরকারের কৃচ্ছতা নীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা।
এসব উদ্যোগ নেয়ার ফলে যে বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলার আয় এবং সাশ্রয় হবে, তা যাতে দেশের বাইরে পাচার না হয়ে যায়, সেজন্য সুদের হার বাড়ানোর উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে সংকটের মাঝেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব।
২০২১ সালের আগস্টে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছিল, বর্তমানে সেটি ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।
রেমিট্যান্স বাড়াতে পারে নতুন প্রবাসীরা
করোনা মহামারী প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ৬৯ শতাংশ কমে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯-এ নেমে আসে। তবে মহামারীর বিধিনিষেধ শিথিলের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতেও এর প্রভাব দেখা যায়।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দেশের জনশক্তি রপ্তানি ১৮৪ শতাংশ বেড়ে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জনে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইতোমধ্যে নতুন অভিবাসীরা রেমিটেন্স পাঠানো শুরু করেছেন। সরকার যদি রেমিট্যান্স নিয়ে কারযকর উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং নগদ প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ায়, তাহলে বৈধ চ্যানেলে দেশে অর্থ পাঠাতে আরও উৎসাহিত হবেন নতুন প্রবাসীরা।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চের (আরএমএমআরইউ) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, দেশে চলমান সংকটের মধ্যেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য সরকারের উচিত রেমিট্যান্সের প্রণোদনা ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে রেমিট্যান্সের প্রণোদনা হার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২.৫ শতাংশ করে সরকার। এছাড়াও মে মাস থেকে রেমিট্যান্স আয়ের বিপরীতে প্রণোদনা গ্রহণের নিয়ম আরও শিথিল হয়েছে। ৫ হাজার মার্কিন ডলার বা ৫ লাখ টাকার কম প্রণোদনার জন্য কোনো কাগজ জমা দিতে হবে না।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের (ঢাকা কারযালয়) সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়বে। কিন্তু এই আয় যদি ব্যাংকিং চ্যানেল বা বৈধ মাধ্যমে না আসে, তাহলে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করবে না।
বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহকে আরও উৎসাহিত করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, খোলা বাজার এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেনের মধ্যে বিনিময়হারের যে বিশাল ব্যবধান দেখা যাচ্ছে তা কমাতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
বর্তমানে আন্ত:ব্যাংক প্রতি ডলারের মূল্য ৯৫ টাকা হলেও খোলা বাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার পাওয়া যাচ্ছে ১১০ টাকায়।
এদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থনৈতিক সংকট নেই। বিশ্ব বাজারে পাম তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম বাড়ায় এসব দেশের অর্থনীতি বরং ভালো অবস্থানে আছে।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেখানে সংকটে সেখানে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জিডিপি চলতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-মার্চ) সৌদি আরবের জিডিপি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯.৬ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৮.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে, মালয়েশিয়ায় চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ৮.৯ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হওয়া এসব দেশের অর্থনীতি সংকটে না থাকায় জনশক্তি রপ্তানি এবং রেমিটেন্স আয় দুটোই উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
অধ্যাপক তাসনিম বলেন, বর্তমান ডলার সংকটকে মাথায় রেখে জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে সরকারকে অভিবাসন ব্যয় কমানোর উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। এ লক্ষ্যে যত দ্রুত কারযকর উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ১২.৮৯ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ কম।
তবে গেল জুলাই মাসে এই আয় ২.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পৌঁছেছে, যা গত ১৩ মাসের মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও চলতি বছরের প্রথম সাত মাসের (জানুয়ারি-জুলাই) রেমিটেন্স আয় মহামারী পূর্ববর্তী ২০১৯ সালের তুলনায় ২২.৫ শতাংশ বেশি।
এদিকে, চলতি ১ থেকে ১৭ আগস্ট সময়ে রেমিট্যান্স আয় এসেছে ১.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি আয় ফিরিয়ে আনা
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর হিসেবে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৫৯.২১ বিলিয়ন ডলারের মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ওই রপ্তানি মূল্যের বিপরীতে দেশে এসেছে ৩১৪.৩৭ বিলিয়ন ডলার। অবশিষ্ট ৪৪.৮৪ বিলিয়ন ডলার প্রত্যাবাসিত হয়নি। যা রপ্তানি আয়ের প্রায় ১২.৪৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য যে রপ্তানি আয় দেশে এখনো আসেনি তা ফিরিয়ে আনার দিকে সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলছেন, বিভিন্ন কারণে রপ্তানি আয়ের পুরোটা প্রত্যাবাসিত হয় না। এখন যেহেতু দেশ ডলার সংকটে আছে, তাই অবশ্যই রপ্তানি পণ্যের মূল ও দেশে আসা আয়ের মধ্যে যে বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে তার কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। যদি কোথাও টাকা আটকে থাকে, তাহলে সেটা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
ইউরোপ-আমেরিকার মন্দায় রপ্তানি ধ্বসে যাবে না
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকায় চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের রপ্তানি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য স্বস্তা দামের তৈরি পোশাক। ওই সব দেশে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ভোক্তারা উচ্চ মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে পোশাকে দিকেই ঝুঁকবে।
জাহিদ হোসেন বলেন, চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে না বলে আমি মনে করি। তবে সংকট দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি আয় বড় ধাক্কা খেতে পারে।
সুদের হার বাড়াতে হবে
বিনিয়োগের খরচ কমানো নিয়ে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল সরকার। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আমানতের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ।
কিন্তু পরবর্তীতে তা পরিবর্তন করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দেয়- মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে আমানতের সুদহার বেশি থাকতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন মাসে আমানতের গড় সুদের হার ছিল ৩.৯৭ শতাংশ এবং গড় মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৭.৫৬ শতাংশ। প্রকৃত সুদহার এখন ঋণাত্মক ৩.৫৯ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রেখে আয় করতে পারছেন না গ্রাহকরা উল্টো টাকার মান কমে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সরকার যদি উপরে উল্লিখিত সুযোগগুলিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে, তাহলে সুদের হারও বাড়ানো উচিত।
সুদের হার না বাড়ানো হলে অর্থপাচার বাড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা। এর ফলে দেশে চলমান মার্কিন ডলারের ঘাটতি আরও তীব্র হয়ে উঠবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলছেন, দেশের ব্যাংকের টাকা রেখে যদি আমনাতকারীরা আয় না করতে পারেন তাহলে টাকা যেখানে বাড়বে সেখানেই চলে যাবে।
তিনি বলেন, সরকারকে অবশ্যই সুষ্ঠু সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সুদের হার আটকে রেখে কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে না।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, শীঘ্রই সুদের হারের সীমা তুলে নেওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই। এছাড়াও মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে আমানতের সুদের হার সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও মানছে না বেশির ভাগ ব্যাংক।
এছাড়াও মার্কিন ডলার সাশ্রয়ের জন্য আমদানি সীমিত করাসহ সরকারের নেয়া উদ্যোগগুলো চলমান রাখার জন্য সুপারিশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, জরুরি সময়ে এ ধরনের বিধিনিষেধ বজায় রাখা উচিত। তবে এটি দীর্ঘ সময় স্থায়ী হলে তা ঐ শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ডলারের বিনিময়মূল্যের ব্যবধান কমানোর সুপারিশও করেন তিনি। একইসঙ্গে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত না রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি কারযকর উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পিআরআই এর এই নির্বাহী পরিচালক।