আরিফুর রহমান তুহিন
বাংলাদেশের পাট খাতের পিছিয়ে পড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে পর্যাপ্ত সরকারি উদ্যোগের অভাব, রপ্তানি গন্তব্যে রাজনৈতিক সংকট, পণ্য পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি আর দেশীয় সিন্ডিকেট অন্যতম।
মহামারি সত্ত্বেও ২০২০-২১ সালে ভালো করেছে পাট খাত। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে খাতটির নেতিবাচক অবস্থা ক্রমেই আরও অবনতি হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মতে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩১ শতাংশ বেড়ে ১.১৬ বিলিয়ন হয়েছে। বেশির ভাগ আয় এসেছে হেসিয়ান, বস্তা, সুতা ও কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে।
এদিকে, রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে ১৭.৪৭ শতাংশ কমে ৪৫৭ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। এ সময়ে, সুতা ও সুতা রপ্তানি কমেছে ১৭.৪৫ শতাংশ, পাটের বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানি কমেছে ৩৪.৯৮ শতাংশ এবং কাঁচা পাট রপ্তানি ৩৩.০৯ শতাংশ বেড়েছে।
পণ্য পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধিতে রপ্তানি প্রভাবিত
মহামারিতে পণ্য পরিবহনের ভাড়া ৪ থেকে ৫ গুণ বেড়েছে এবং আগের বছরের তুলনায় তা এখনও বেশি। পাট থেকে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ শিপিং খরচ বেড়ে যাওয়া বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও তুলিকা-এর সিইও এসরাত জাহান চৌধুরী বলেন, রপ্তানি গন্তব্যের দেশগুলোতে পণ্য পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, উচ্চ পরিবহন ভাড়া মূল সমস্যার মধ্যে একটি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ৪০ সিএফটি কন্টেইনারে ১৫ হাজার ডলার মূল্যের পাট পণ্য রপ্তানি করেছি, অথচ ১৫ হাজার ডলারের পণ্যের কন্টেইনার ভাড়া ১৬ হাজার ডলার। যে কারণে, গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর আগেই পণ্যের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়।
রপ্তানি গন্তব্যে সংকট
বাংলাদেশী পাটজাত পণ্যের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য তুরস্ক ও ইরানের মুদ্রা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ায় তাদের মুদ্রার মান হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান মো: আবুল হোসেন দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, দুটি দেশই আমাদের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। এ কারণে আমরা ভালো করতে পারছি না।
তিনি বলেন, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ভালো পারফরম্যান্স করলেও বাস্তবে কাঁচা পাটের উচ্চমূল্য উৎপাদনকে ব্যয়বহুল করেছে। যদি আমরা হিসাব করি, তবে দেখতে পাবো যে, উচ্চ মূল্যের কারণে পরিমাণ কমেছে।
রপ্তানিকারকরা দাবি করেছেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে লিরার সাম্প্রতিক অবমূল্যায়ন পাট খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এসরাত বলেন, আমাদের প্রধান রপ্তানি দেশ হলো তুরস্ক, তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন গত তিন মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এতে তুর্কি ক্রেতাদের ক্রয় কমাতে বাধ্য করেছে, এটি সামগ্রিক রপ্তানিকে প্রভাবিত করেছে।
দামের কারসাজিতে সিন্ডিকেট
পাটকল মালিক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, সমস্যার মূলে রয়েছে সিন্ডিকেশন। সিন্ডিকেট গত দুই বছর ধরে কাঁচা পাটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে এক মণ (৩৭.৩২ কেজি) কাঁচা পাট বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকায় এবং কৃষকরা তা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছিল। চলতি মৌসুমে কৃষকরা প্রতি মণ কাঁচা পাট বিক্রি করেছেন ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়।
রপ্তানিকারকদের দাবি, মধ্যস্বত্বভোগীরা আবারও পাটের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছে। দেশীয় বাজারে পর্যাপ্ত কাঁচা পাটের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং সিন্ডিকেট ঠেকাতে লাইসেন্স ছাড়া পাট ব্যবসা নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
৯ আগস্ট পাট মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, ব্যবসায়ীরা এক মাসের বেশি ১ হাজার মণের বেশি পাট মজুত রাখতে পারবেন না। কিন্তু পাটকল মালিকরা বলেছেন, কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বিজেএমএর পরিচালক মো নাজমুল হক দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, উদাহরণস্বরূপ, ভারত কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। শিল্প এবং কৃষকদের জন্য সবকিছু করছে ভারত। সিন্ডিকেটের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশে আইন আছে, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না।
এসরাত বলেন, কাঁচা পাটের উচ্চ দামের কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। ক্রেতারা দাম কমানোর জন্য আমাদের চাপ দেয়, কিন্তু কাঁচা পাটের দাম যখন এতো বেশি, তখন আমরা তা কীভাবে করবো?
পাট রপ্তানি উন্নয়নের অভাব
রপ্তানিকারকরা বলছেন, তাদের বিপণন ক্ষমতা ভারতীয়দের তুলনায় কম। বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা বাড়া সত্ত্বেও সরকার পাট পণ্যের প্রচারের জন্য কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ তাদের।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাটজাত পণ্যের প্রচারের জন্য বাজার গবেষণা এবং লক্ষ্যের দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া প্রয়োজন। বিকল্পভাবে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে।
এসরাত বলেন, কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক মেলা নেই। আমাদের অধিকাংশ রপ্তানিকারক ক্ষুদ্র বা কুটির শিল্পের মালিক। অর্থায়ন আমাদের জন্য ইউরোপ বা আমেরিকার দেশগুলোতে এক্সপোতে অংশগ্রহণ করা কঠিন করে তোলে।
রপ্তানিকারকরা দাবি করেন, তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট আমদানি করে এবং তৈরি পণ্য তৈরি করে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন গন্তব্যে রপ্তানি করে। সেসব দেশে তাদের দূতাবাসগুলো রপ্তানি বাড়াতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
বিজেজিইএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ভারত তৎপর হলেও আমাদের অধিকাংশ দূতাবাস এ বিষয়ে সচেতন নয়। কেউ কেউ পাটজাত পণ্যের প্রসারে চেষ্টা করলেও তা যথেষ্ট নয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের রপ্তানিকারকরা কোথা থেকে সহায়তা পাবে, সে বিষয়ে কোনো বাজার গবেষণা নেই। তাহলে, আমরা কীভাবে ভালো পারফর্ম করব?
বিজেএমএর সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, তারা রপ্তানি আয়ে প্রণোদনা পান। এ খাতে বিশাল গবেষণা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পাট পণ্যের প্রচারে বিশেষ মেলা বা প্রদর্শনী না হলেও এ খাতকে এগিয়ে নিতে তাদের পরিকল্পনা রয়েছে।
তপন বলেন, এটা সত্য যে, পাট পণ্যের প্রচারে বিশেষ কোনো ফোকাস নেই কিন্তু আমাদের কিছু রপ্তানিকারক ইপিবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মেলায় অংশ নিচ্ছেন। আমাদের কিছু পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু মহামারির কারণে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এবার আন্তর্জাতিক মানের এক্সপো আয়োজন করা কঠিন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এক্সপোতে অংশগ্রহণের জন্য একটি সময়সূচি অনুমোদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।