প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

২ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে রিং শাইন টেক্সটাইল

নিয়াজ মাহমুদ
১৮ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:৫৫:২৯ | আপডেট: ২ years আগে
২ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে রিং শাইন টেক্সটাইল

গত ২২ বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইল লিমিটেডের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে আগের মালিকপক্ষ। যার মূলে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুং ওয়ে মিন, যিনি ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক।

পুঁজিবাাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অধীনে একটি তদন্ত কমিটি এবং বিশেষ নিরীক্ষকের সংকলিত একটি প্রতিবেদনে এ অনিয়মের ঘটনাটি উঠে এসেছে।

বিএসইসির এ প্রতিবেদনটি সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধানের কাছে পাঠানো হয়েছে এবং দ্য বিজনেস পোস্ট একটি অনুলিপি পেয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, কোম্পানিটির মালিকপক্ষ টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার (টিটি) এর মাধ্যমে ১২৪ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা পাচার করেছে। তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্পনসর পরিচালক এবং বেশকিছু অজানা বিদেশী অ্যাকাউন্টে এ তহবিল স্থানান্তর হয়েছে ৷

এ ছাড়াও, আমদানিতে মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়ে কোম্পানিটি ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল সংগ্রহের নামে ৮৪৫ কোটি টাকা পাচার করেছে।

এর পাশাপাশি, একজন ব্যবসায়ী ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে কোম্পানিটির দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে যথাক্রমে ১৯.২ কোটি এবং ২০ কোটি টাকা পাচার করেছেন।

উল্লেখ্য, কোম্পানির সমস্ত স্পনসর ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং তাইওয়ানের বাসিন্দা।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবিএম মির্জা আজিজুল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, নিরীক্ষক সংস্থা এবং ইস্যু ব্যবস্থাপক এ বিষয়ে তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।’

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জা উল্লেখ করেছেন, ‘এই ধরনের আর্থিক অনিয়মের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত এবং তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত।’

এক সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগ

১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রিং শাইন টেক্সটাইল লিমিটেড কোম্পানিটি ২০১৯ সালে পুজিঁবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। পুঁজিবাজার থেকে তখন ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে কোম্পানিটি।

কোম্পানিটি ৩০ জুন, ২০১৯ পর্যন্ত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল এবং সংশ্লিষ্ট শেয়ারহোল্ডারদের বোনাস শেয়ার বিতরণ করেছিল এবং পরিশোধিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করেছিল।

তালিকাভুক্তির দ্বিতীয় বছরে, কোভিড-১৯ সংকটের কারণে বিদেশি ক্রেতা কমে যাওয়া এবং কাঁচামাল আমদানিতে ঘাটতির কথা উল্লেখ করে, ঢাকার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ঢাকা ইপিজেড) অবস্থিত সাভার প্ল্যান্টটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এক মাসব্যাপী বন্ধ ঘোষণা করে। যা পরে তিনবার বাড়ানো হয়।

এ অচলাবস্থা সমাধানে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারী কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বিএসইসি এবং কোম্পানিটিকে পুনরায় চালু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি নতুন বোর্ডকে দায়িত্ব দেয়।

এরপর ২০২১ সালের জুনে কোম্পানি ঘোষণা করেছিল, এটি প্রায় নয় মাস বন্ধ থাকার পরে আবার উৎপাদন শুরু করবে। কোম্পানিটি সেসময় আরও বলেছিল, তারা ১৩ জুন থেকে উৎপাদন সক্ষমতার ২৫ শতাংশ ব্যবহার করে পুনরায় উৎপাদন শুরু করবে।

তবে ২১ ও ২২অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি এবং গত অর্থবছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ১.৫৪ টাকায় দাঁড়ায়। এই অবস্থায় ২০২২ সালে ইউনিয়ন গ্রুপ অফ কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইল লিমিটেড অধিগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।

বিএসইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিং শাইন টেক্সটাইল বানোয়াট নিরীক্ষিত আর্থিক বিবৃতির ভিত্তিতে ব্যক্তিগত এবং পাবলিক অফারিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়েছে।

এছাড়াও কোম্পানির ১১ জন স্পন্সর পরিচালক বা অধিকাংশ শেয়ারহোল্ডারই কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে উপরোক্ত শেয়ারের বরাদ্দের বিপরীতে কোনো টাকা জমা করেননি। কোম্পানির ৩৩ জন বহিরাগত শেয়ারহোল্ডার রয়েছে।

অন্যদিকে, বেশ কিছু শেয়ারহোল্ডারদের জমা করা টাকা ওই ব্যবসায়ীর বেশ কয়েকটি নগদ চেকের মাধ্যমে পাচার করেছেন।

বিএসইসির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই ব্যবসায়ী এবং তার পরিবার, নিরীক্ষক, ইস্যু ম্যানেজার এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সহ কোম্পানির কতৃপক্ষ বেশ কয়েকটি সিকিউরিটিজ আইন এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন লঙ্ঘন করেছে।

কোম্পানির আইপিও তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুং ওয়ে মিন, যিনি রিং শাইনের মোট ১ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ৬৫০টি শেয়ারের মালিক ছিলেন। যার ঠিকানা ছিল ইন্দোনেশিয়ার লিউইগাজাহ, সিমাহি-এর বান্দুংয়ে ৷

বিএসইসির বিশেষ নিরীক্ষক, হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিবেদনে দেখা যায়,টিটির বিপরীতে কোম্পানিটির সন্ত্রপাতি আমদানির কোন নথি রিং শাইন দেখাতে পারেনি।

তদন্ত কমিটির তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে কোম্পানিটি ৩ হাজার ৩১১ কোটি টাকার কাঁচামাল কিনেছে। যদিও ভ্যাট রিটার্ন দেখায় কোম্পানিটি প্রকৃতপক্ষে ২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকার কাঁচামাল ক্রয় করেছে। কাঁচামাল কেনার নামে কোম্পানির মালিকপক্ষ ৮৪৫ কোটি টাকা পাচার করেছেন।

এছাড়াও, প্রি-আইপিও এবং আইপিও প্রক্রিয়ায় এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড এবং সিএপিএম অ্যাডভাইজরি লিমিটেড নামে দুটি ইস্যু ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অনিয়ম পায় বিএসইসির তদন্ত কমিটি।

এদিকে রিং শাইনের বর্তমান কোম্পানি সেক্রেটারি অনিরুদ্ধ পিয়াল তাদের কোম্পানিতে অতীতে কিছু আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, এই অনিয়মগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরে আনা হয়েছিল, তারপরে এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বিএসইসির একটি নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ করা হয়েছিল। তবে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনিয়মের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত উল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘আমরা কোম্পানিটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনিয়ম শনাক্ত করেছি এবং সেগুলো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানকে জানিয়েছি। তারা এখন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের একটি বিশিষ্ট শিল্পগোষ্ঠী রিং শাইন অধিগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।বিনিয়োগকারীরা এই উদ্যোগ থেকে উপকৃত হবে।’

যারা সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে বিএসইসি আইনি ব্যবস্থা নেবে বলেও হুশিয়ারি দেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, রিং শাইনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক যেন বাংলাদেশ ত্যাগ করতে না পারেন এ ব্যাপারে বিএসইসি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।