প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

৩৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা পেল অ্যাননটেক্স

মেহেদী হাসান
০১ মার্চ ২০২৩ ২০:৪১:২৭ | আপডেট: ১ year আগে
৩৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা পেল অ্যাননটেক্স

তিন হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা পেয়েছে বহুল আলোচিত সমালোচিত অ্যাননটেক্স গ্রুপ। পুরো ঋণের টাকা পরিশোধের শর্তে পোশাক খাতের গ্রুপটিকে এই সুবিধা দিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক।

গ্রুপটির সুদবাবদ মোট তিন হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার মধ্যে ২০৮৩ কোটি টাকা আরোপিত সুদ; ৯৭২ কোটি টাকা অনারোপিত সুদ এবং ৩০২.৯৯ কোটি টাকা দন্ড সুদ।

গত বছরের নভেম্বরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অ্যাননটেক্সকে এই সুদ মওকুফ সুবিধা দিয়েছে বলে বিজনেস পোস্টকে জানান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এস এম মাহফুজুর রহমান।

তিনি বলেন, চলতি বছরের জুনের মধ্যে গ্রুপটি তাদের সকল দায় দেনা পরিশোধ করে দিবে। ইতোমধ্যে কোম্পানিটি ১৪১ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে বলে জানান ব্যাংক কর্মকর্তারা।

২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ২২ কোম্পানির মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫২৭.৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এই ঋণ প্রদানে একক গ্রাহক ঋণসীমা লঙ্ঘণ করেছিল ব্যাংকটি ।

অনিয়মের মাধ্যমে প্রদানকৃত এই ঋণ ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য অবনতির দিকে নিয়ে গেছে। গত কয়েক বছর ঋণের কিস্তি অনিয়মিত হওয়ার পর, চলতি বছরের জুনের মধ্যে অ্যাননটেক্স ঠিক কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যাংকিং খাত বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিজনেস পোস্ট জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবদুস সালাম আজাদের সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জনতা ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এস আলম গ্রুপ অ্যাননটেক্সের ঋণের দায় গ্রহণ করছে। মাহফুজুর বলেন, আননটেক্স আগামী ছয় মাসের মধ্যে জনতা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন শেষ করবে।

এস আলম গ্রুপ অ্যাননটেক্সের ঋণের দায়দেনা কেন কিনবে? জিজ্ঞাসা করা হলে, মাহফুজুর বলেন, "গ্রুপটি আমাদের ব্যাংকের দায়সহ অ্যাননটেক্সের বেশ কয়েকটি কোম্পানি কিনেছে। কিন্তু আমরা এই বিষয়ে এস আলম গ্রুপ কী ভাবছে তা জানি না।

"ঋণ আদায় করাই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী নই।"

তিনি বলেন, “আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী অ্যাননটেক্স ঋণের সুদ মওকুফ করেছি। সুদ মওকুফ করার বিধান রয়েছে, যা তহবিলের ব্যয় আদায় সাপেক্ষে। এটি খারাপ ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যবহৃত একটি আদর্শ অনুশীলন।

তিনি আরও বলেন, “পুরো প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলে জনতা ব্যাংক স্বাস্থ্য উন্নতি হবে। আমরা কয়েক বছর ধরে অ্যাননটেক্সের ঋণ পুনরুদ্ধার করতে পারিনি। অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন বা এনওসি (অনাপত্তি সনদ) নিয়ে এই প্রক্রিয়া চলছে।”
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঋণ পুনঃনির্ধারণ এবং সুদ মওকুফের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত প্রবিধান এবং সার্কুলার রয়েছে। কোনও ব্যাংক সেই নিয়ম অনুসারে ঋণের পুনর্নির্ধারণ বা সুদ মওকুফ করতে পারে।

এ ধরনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ মেজবাউল হক বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। তবে সুদ মওকুফ বা ঋণ পুনর্নির্ধারণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন অপরিহার্য নয়।

এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আননটেক্স জুনের সময়সীমার মধ্যে তাদের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ রয়েছে।

"এর মতো একটি গ্রুপ কীভাবে এত বড় সুদ মওকুফ পায়?" জনতা ব্যাংক কেন অ্যাননটেক্স থেকে বেরিয়ে যেতে চায়?

জনতা ব্যাংক বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বনামধন্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলির মধ্যে একটি ছিল, কিন্তু অ্যাননটেক্স এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপকে কেন্দ্র করে ঋণ কেলেঙ্কারিতে এ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতির পিছনে মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০১৭ সালের শেষ দিকে ব্যাংকটির মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। যা পরবর্তীতে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ১৪ হাজার ৩৮৬.৭৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তের সময় অ্যাননটেক্স গ্রুপকে দেয়া ঋণে ক্ষেত্রে অসংখ্য অনিয়ম পাওয়া যায়। পরে ২০১৮ সালে ব্যাংকটিকে একটি কার্যকরী অডিট পরিচালনা করার এবং কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, ব্যাংকটি গত চার বছরে ইস্যুটির বিষয়ে কোনো কার্যকরী অডিট পরিচালনা করেনি বা অ্যাননটেক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপও নেয়নি।

জনতা ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কার্যকরী অডিট পরিচালনা করতে ইচ্ছুক নয়। কারণ তাদের কিছু নির্বাহী অনিয়মের সাথে জড়িত, নাম প্রকাশ না করার জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন।

তারা আরও বলেন, ম্যানেজমেন্ট এখন অ্যাননটেক্স ঋণ আদায় করে কেলেঙ্কারির সঙ্গে সম্পর্ক এড়াতে চায়।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে, অ্যাননটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ইউনুস বাদল এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।