প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণ পেলো ‘অখ্যাত’ বিজনেস গ্রুপ

মেহেদী হাসান
০২ অক্টোবর ২০২২ ১৯:২৬:৩০ | আপডেট: ১ year আগে
৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণ পেলো ‘অখ্যাত’ বিজনেস গ্রুপ

উত্তরবঙ্গের কোম্পানি নাবিল গ্রুপকে সহজ শর্তে ৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে শরিয়াহভিত্তিক তিন ব্যাংক। এগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

চলতি বছরের জুনে অনুষ্ঠিত বোর্ড মিটিংয়ে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ অনুমোদন করেছে শরিয়াহভিত্তিক এ তিন ব্যাংক। এ সংক্রান্ত তথ্যের কপি দ্য বিজনেস পোস্টের হাতে এসেছে।

এদিকে নাবিল গ্রুপকে দেয়া ঋণকে "ঝুঁকিপূর্ণ এবং সন্দেহজনক" বলে অভিহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ এ গ্রুপের বেশিরভাগ কোম্পানি ছোট পরিসরের ও নতুন প্রতিষ্ঠিত।

তিনটি ব্যাংকের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের একটি অনুলিপিও সংগ্রহ করেছেন এ প্রতিবেদক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের কাছে এ সংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যাও চাইবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন ব্যাংক তিনটিকে সহজ শর্তে এত বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করেছে।

এ কর্মকর্তা আরও জানান, এতো বড় ঋণের পেছনে কোম্পানির পরিচালকদের হাত রয়েছে কি না, সে বিষয়ে খতিয়ে দেখার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়াও এ বিষয়ে একটি তদন্ত শুরু হবে।

ঋণের এ বিষয়টিকে ''খুবই খারাপ'' বলে অভিহিত করেছেন সিনিয়র ব্যাংকার ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন।

তিনি বলেন, এ ব্যবসায় দেয়া ঋণের পরিমাণটি অনেক বড়। যারা এতো বড় ঋণ নিয়েছে, তা পরিশোধের ইচ্ছা নাও থাকতে পারে কোম্পানিটির।

তিনি আরও বলেন, বিশাল অঙ্কের এ ঋণ প্রক্রিয়ায় কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী জড়িত থাকতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা।

একটি নতুন ব্যবসা কীভাবে তিন ব্যাংক থেকে এত বড় অঙ্কের ঋণ পেয়েছে- তা খুঁজতে তদন্ত শুরু করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে বিজনেস পোস্টের পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মওলা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের সৈয়দ ওয়াসেক মোহাম্মদ আলী এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের জাফর আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে ইসলামী ব্যাংক

চলতি বছরের ৫ জুন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) এর ১৯৭০তম নির্বাহী কমিটির সভায় নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডকে ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে বিতরণ করার জন্য ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে।

কোম্পানির সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট অনুসারে, বেশ কয়েকটি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৮ দশমিক ৫ লাখ টাকার এক্সপোজার ছিল।

অভ্যন্তরীণ ক্রেডিট রিস্ক রেটিং সিস্টেম (আইসিআরআরএস) অনুযায়ী কোম্পানিটি প্রান্তিক শ্রেণীর (নতুন কোম্পানি) অন্তর্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক তার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কোম্পানির কাছ থেকে আমানত হিসেবে ১১০ কোটি টাকাসহ জামানত হিসেবে আইবিবিএলের অন্তত ২৩০ কোটি টাকা নেয়া উচিত ছিল। সহজ শর্তে দেয়া এসব ঋণগুলি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা চলতি বছরের জুনে নাবিল ফিড মিলস লিমিটেডকে ৭০০ কোটি টাকাসহ নাবিল গ্রুপের বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে।

সভার কার্যবিবরণীতে, ব্যাংক দাবি করেছে, নাবিল ফিড মিলস লিমিটেড এবং নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেড একই গ্রুপের কোম্পানি নয়। তবে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানই নাবিল গ্রুপের বলে সন্দেহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

যদি ঐ দুটি প্রতিষ্ঠানই একই গ্রুপভুক্ত হয় তাহলে ইসলামী ব্যাংক একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করবে, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

এক হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে এসআইসিএল

চলতি বছরের ৩০ মে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) এর ৪৮১তম বোর্ড সভায় নাবিল ফিড মিলস লিমিটেড, নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে এক হাজার ১২০ কোটি টাকা (তহবিলযুক্ত এবং নন-ফান্ডেড উভয়) ঋণ অনুমোদন করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসআইবিএল নাবিল গ্রুপের ঋণ অনুমোদনের জন্য তার নিয়মাবলী এবং শর্তাবলী শিথিল করেছে। এজন্য এর দেয়া ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণদাতা এলসি কমিশন কমিয়েছে, জামানত এবং ব্যক্তিগত গ্যারান্টি জমা থেকে ছাড় দেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এসআইবিএল এই ঋণ গ্রহীতা ক্লায়েন্টকে কোনো ধরনের বেআইনি সুবিধা দিচ্ছে কিনা এবং কোম্পানিটি এ ব্যাংকের কোনো পরিচালকের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান কিনা তা খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এক হাজার ২০০ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে এফএসআইবিএল

চলতি বছরের ২৩ জুন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এফএসআইবিএল) এর ২৪৬তম বোর্ড সভায় নাবিল ফিড মিলস লিমিটেড, নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা (তহবিলযুক্ত এবং নন-ফান্ডেড) ঋণ অনুমোদন করেছে।

কেন এত বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করেছে সেইসব কোম্পানিকে তার তথ্য ব্যাংকের কাছে তথ্য চাওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোম্পানির পরিচালকদের প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও তথ্য চাইবে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা জানান, তিনটি শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকের বেশিরভাগ পরিচালক চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যবসায়ী পরিবারের এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সন্দেহ, এই পরিচালকরা নাবিল গ্রুপকে সহজ শর্তে মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়ার সাথে জড়িত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করে বলেন, ওই তিনটি ব্যাংক তাদের নিজস্ব নিয়ম লঙ্ঘন করে বিপুল পরিমাণ ঋণ অনুমোদন করেছে।

তিন ঋণদাতার প্রতিষ্ঠানের খারাপ ঋণের অবস্থা

এ বছরের জুন শেষে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অ-পারফর্মিং লোন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫১০ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের এনপিএল ছিল এক হাজার ৬২৮ দশমিক ৭৯ কোটি টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের মন্দ ঋণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৮৫ দশমকি ১২ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী।

নাবিল গ্রুপের অধীনে বেশিরভাগ কোম্পানিই নতুন প্রতিষ্ঠিত, তবে গ্রুপের ওয়েব পোর্টাল দাবি করে, এটি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের বৃহত্তম এবং নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে একটি।

নাবিল গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোঃ আমিনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের নগদ প্রবাহ ভালো, আর সে কারণেই ওই ব্যাংকগুলো আমাদের গ্রুপকে টাকা ঋণ দেয়। এই ঋণদাতারা আমাদের গ্রুপকে অর্থায়ন করতো না যদি আমরা একটি বিখ্যাত ব্যবসায়িক সংস্থা না হতাম।’’