হাসান আল জাভেদ
অবৈধ ‘ই-গিফট কার্ড’ ব্যবসার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করছে কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। আর এ প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়া অধিকাংশই তরুণ ও কিশোর-কিশোরী।
প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধভাবে ভার্চুয়াল গিফট কার্ডের মাধ্যমে ই-মানি তৈরি করছে। যেমন সিনেমা দেখা, ইউটিউব কিংবা ফেসবুকে কোনো পণ্য-সেবা বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে বোস্ট করার জন্য এমনকি সাবস্ক্রিপশন ফি দিতেও এসব ই-মানি ব্যবহৃত হয়।
তারা গ্রাহকদের পেপ্যাল, ডেবিট, ভিসা বা মাস্টারকার্ডের মতো পরিষেবায় অর্থ স্থানান্তর করতে সহায়তা করে। এ প্রক্রিয়ায় অপারেটররা স্থানীয় মুদ্রায় পেমেন্ট গ্রহণ করেন এবং পরে তা মার্কিন ডলারে রূপান্তর করে।
এ পরিষেবা প্রদানকারীদের মধ্যে রয়েছে দারাজ.কম, বিডি টেকট্রিক.কম, ইকার্ড.কম.বিডি, গিফট কার্ডস জোন বিডি.কম এবং গিফট কার্ড হাউস।
তারা দেশীয় গ্রাহকদের কাছ থেকে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) যেমন- বিকাশ, নগাদ এবং রকেটে ভার্চুয়াল কার্ড বা পণ্যের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে। এরপর আন্তর্জাতিক পরিষেবা প্রদানকারী বা কোম্পানিকে অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে অনেকেই ভার্চুয়াল পেপ্যাল, ডেবিট ভিসা বা মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে আমাজন, আলিবাবার মতো ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্য কিনে থাকেন। গুগল প্লে, অ্যাপল আইটিউনস, এক্সবক্স এবং প্লেস্টেশন, নিন্টেন্ডো, স্টিম এবং আরও অনেক গিফট কার্ড দেশে পাওয়া যায়।
বেশ কয়েকটি ভার্চুয়াল কার্ড প্রদানকারী দ্য বিজনেস পোস্ট'কে জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যে কেউ পেপ্যাল অ্যাকাউন্টে, যে কোনো পরিমাণ অর্থ পাঠাতে পারে এবং আন্তর্জাতিক ই-কমার্স কোম্পানি থেকে যেকোনো কিছু কিনতে পারে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে বিজনেস পোস্ট। এ প্রতিবেদক গ্রাহক হিসেবে ই-গিফট কার্ড স্টোর ‘বিডি টেকট্রিক.কম’-এর স্বত্বাধিকার জাহিদ হাসান বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করেন। তখন তিনি জানান, কোনো অতিরিক্ত চার্জ ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেপ্যাল একাউন্টে যে কোনো পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো গ্রাহক যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো দেশে টাকা পাঠাতে চায়, তাহলে তাকে অতিরিক্ত ফি দিতে হবে। তাদের এমএফএসের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করতে হবে। এটা অনেকটা হুন্ডি পদ্ধতির মতো।
হুন্ডি হলো,অবৈধ অর্থ স্থানান্তর পদ্ধতি, যা সরকারকে কর থেকে বঞ্চিত করে।
বিডি টেকট্রিক.কম ৫০ থেকে ১০০ ডলার মূল্যের গিফট কার্ড অফার করে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকার জাহিদের দাবি, তারা অর্থ পাচার করছেন না।
তিনি দ্য বিজনেস পোস্ট'কে বলেন, আমরা পেওনিয়ার ব্যবহার করে ডলারে যে কোনো পরিমাণ বিনিময় করতে পারি। এ পরিষেবাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত। ৫০ ডলারের নিচে পেমেন্টের জন্য গিফট কার্ড ব্যবহার করি।
‘গিফট কার্ড বিডি’-এর স্বত্বাধিকার জয় মাহমুদ বলেন, বিদেশে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কিছু বাংলাদেশি এ লেনদেন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো সিরাজুল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্ট'কে বলেন, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদিত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানই জাহাজে টাকা পাঠাতে পারে এবং মাস্টারকার্ড বা ভিসা কার্ড ইস্যু করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই দেশে আন্তর্জাতিক আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান পেপ্যাল, ডেবিট ভিসা এবং মাস্টারকার্ডের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান লেনদেন করছে। তাদের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
দারাজ অনলাইন শপিংয়ের ফ্ল্যাগশিপ স্টোর দারাজমল ভার্চুয়াল গুগল প্লে স্টোরে গিফট কার্ড বিক্রি করে। এটি ফেসবুকে পেইড ক্যাম্পেইন দিয়ে বাংলাদেশি গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
দারাজের নিয়ম অনুযায়ী, গ্রাহকদের সেবা পেতে হলে তাদের বয়স ১৩ বছরের বেশি হতে হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে কেউ স্থানীয় মুদ্রায় এমএফএসের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে তাদের ভার্চুয়াল গিফট কার্ড কিনতে পারে।
মো ফরহাদ মোল্লা নামের এক গ্রাহক দ্য বিজনেস পোস্ট'কে বলেন, তিনি এ মাসে দারাজমল থেকে বেশ কয়েকটি উপহার কার্ড কিনেছেন। যে কেউ এ প্ল্যাটফর্ম থেকে ঝামেলা ছাড়াই ভার্চুয়াল উপহার কার্ড কিনতে পারে।
তবে, এ বিষয়ে দারাজ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
বাংলাদেশের আর্থিক অপরাধ তদন্তকারীরা বলছেন, যেসব কিশোর-কিশোরীরা স্মার্টফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে অনলাইন গেম খেলে, তারাই এ ভার্চুয়াল গিফট কার্ড কিনে থাকে।
বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ী ই-কমার্স সাইট বা ফেসবুকে পণ্য বিক্রি, ইউটিউবে ভিডিও ক্লিপ প্রচার করে তারা ব্যাংকিং সিস্টেমের ঝামেলা এবং সরকারের ১৫ শতাংশ ভ্যাট এড়াতে ভার্চুয়াল কার্ড ব্যবহার করছে।
যখন বিনিময় হার প্রায় ৮৫ টাকা থকে তখন গিফট কার্ডস এক ডলারের বিপরীতে ৫৮ টাকা চার্জ আদায় করে।
গিফট কার্ডসের স্বত্বাধিকার মোহাম্মদ সাইফ বলেন, এটা তাদের ব্যবসা বাড়ানোর কৌশল।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে পেপ্যাল, বিটকয়েন লেনদেন বিভিন্ন গোপন পদ্ধতিতে করা হয়। আমরা এই সুবিধাগুলো পাচ্ছি।
খুলনার বেলায়েত হোসেন রোডে অবস্থিত গিফট কার্ড হাউস। সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ভার্চুয়াল গিফট কার্ড বিক্রি করছে। তারা এক ডলারের বিপরীতে ৬৫ টাকা চার্জ আদায় করে।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকার ইব্রাহিম খলিল জানান, তার কাছে গিফট কার্ডের ভালো স্টক আছে।
তিনি বলেন, যদি প্রয়োজন হয় শুধু উপহারের কার্ডগুলো কিনুন। পেমেন্ট পদ্ধতি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
ইকার্ড.কম.বিডি ফেসবুক বা ইউটিউবে বুস্টিং-এর জন্য 'ভ্যানিলা ভিসা উপহার কার্ড এবং ভ্যানিলা মাস্টার কার্ড' বিক্রি করে।
কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, এটি ইন্সট্যান্ট ইমেইল ডেলিভারিসহ একটি সহজ পেমেন্ট পদ্ধতি। তাদের বিকাশ, রকেট, নগাদ এবং ব্যাংক ট্রান্সফারের মতো একাধিক পেমেন্ট অপশন আছে এবং পেমেন্টে কোনো সার্ভিস চার্জ বা অতিরিক্ত ফি নেই।
ইকার্ডের একজন কর্ণধার দ্য বিজনেস পোস্ট'কে বলেন, আর্থিক কার্ড পরিষেবা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. মেসবাউল হক বলেন, সকল বিদেশি গিফট কার্ডের মানিব্যাগ সার্ভিস বাংলাদেশে অবৈধ। এর মধ্যে রয়েছে পেওনিয়ার এবং লটারি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই বিষয়ে ২০১৯ এবং ২০২১ এর মধ্যে দুটি পাবলিক নোটিশ প্রকাশ করেছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক মতামত চেয়েছিল। তারাও জানিয়েছে বাংলাদেশে পেমেন্ট সেবা অবৈধ।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (ফিনান্সিয়াল ক্রাইম) বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, ভার্চুয়াল লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা সহজ। এটা এক ধরনের হুন্ডি।
এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, যারা অর্থ পাচার করছে, আমরা সেসব অনলাইন ভার্চুয়াল কার্ড ব্যবসা সম্পর্কে অবগত আছি। আমাদের দল বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।