নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার আখড়ায় পরিণত হয়েছে দেশের প্রাইম ইসলামি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি। সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ, পলিসি হোণ্ডারদের প্রিমিয়ামের টাকা অলাভজনক খাতে বিনিয়োগ, দীর্ঘদিন গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ না করাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই অব্যবস্থাপনা ও বীমা আইন লঙ্ঘন করে ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে কোম্পানির বিনিয়োগের পরিমাণ ১৫৩ কোটি টাকা যা বিনিয়োগ যোগ্য সম্পদের ১৯ শতাংশ। বীমা আইন অনুযায়ী, সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে লাইফ বীমাকারির মোট সম্পদের ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করার বিধান থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত ৭১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
অপরদিকে, ২০২১ সাল শেষে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট লাইফ ফান্ডের ৮০৯ কোটি টাকার বিপরীতে বিনিয়োগ রিটার্নের পরিমাণ মাত্র ০.৯৫ শতাংশ বা ৭.৬৯ কোটি টাকা ।, কোম্পানির মোট বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ ৮০৯ কোটি টাকা। বিনিয়োগযোগ্য এই সম্পদের ২৪২ কোটি টাকা সরকারী সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোম্পানির প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ১৮ কোটি। যা মোট বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের মাত্র ২ শতাংশ।
কোম্পানির বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় সম্বলিত একটি সময়াবদ্ধ বাস্তব পরিকল্পনা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে ২০ দিনের মধ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ(আইডিআরএ) কে দাখিল করতে বলা হয়েছে। একইভাবে, চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সকল অনিষ্পন্ন বীমা দাবি নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে আইডিআরএ। পাশাপাশি লাইফ ফান্ডের অর্থ কোথায় কিভাবে বিনিয়োগ করা হয়েছে সেই তথ্যও চেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
প্রাইম ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) অনুষ্ঠিত একটি সভার কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে। গত ২৮ নভেম্বর সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
অনিষ্পন্ন বীমা দাবি ৩১.১৭ কোটি টাকা : আইডিআরএ তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে কোম্পানির বর্তমান অনিষ্পন্ন বীমা দাবির পরিমাণ ৩১.১৭ কোটি টাকা। এছাড়া আগামী ৫ বছরে ২১০০ কোটি টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে এ অর্থ পরিশোধে কোম্পানির কি পরিকল্পনা রয়েছে সে বিষয়ে কোম্পানির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
স্থাবর সম্পত্তি খাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগ : প্রাইম ইসলামি লাইফের স্থাবর সম্পত্তিতে কোম্পানির বিনিয়োগের পরিমাণ ২৭৭ কোটি টাকা কিন্তু স্থাবর সম্পত্তি খাতে বিনিয়োগের অনুমোদিত সীমা ১৬২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটি স্থাবর সম্পত্তি খাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগের পরিমাণ ১১৫ কোটি টাকা। একইভাবে, কোম্পানির Balance sheet অনুযায়ী মোট সম্পত্তির ২৩ শতাংশ অর্থাৎ ২২৫ কোটি টাকা চলতি সম্পদ হিসেবে রয়েছে যা যথাযথভাবে বিনিয়োগ হলে কাঙ্খিত রিটার্ন পাওয়া যেত।
অপরদিকে, কোম্পানি স্টারলিং গ্রুপে ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে যা বিনিয়োগ প্রবিধানমালা অনুযায়ী যথাযথ প্রতীয়মান হয়না। এ বিনিয়োগের অর্থ নগদায়ন করা জরুরি হলেও কোম্পানি তা নগদায়ন করছে না।
একইভাবে, ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট প্রভাইডার 'বাংলালায়ন কমিউনিকেশন লিমিটেডে' প্রাইম ইসলামী লাইফ কোম্পানি লিমিটেড ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বাংলালায়ন বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনা করছে না বিধায় উক্ত বিনিয়োগ থেকে কোন মুনাফাও পাওয়া যাচেছ না।
কোম্পানির নগদ প্রবাহ বিবরণীর (cash flow statement) বিনিয়োগ কার্যক্রমের (Investing Activities) মাধ্যমে সৃষ্ট প্রবাহ পর্যালোচনায়া দেখা যায় যে, ২০১৭ সাল হতে নেতিবাচক যা কোম্পানির সামগ্রিক আর্থিক অব্যবস্থাপনার পরিচায়ক।
লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত শেয়ারহোল্ডাররা : আইডিআরএ সূত্রে আরও জানায়, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩৮ শতাংশ এর মালিক পরিচালকগণ এবং অবশিষ্ট অংশ সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের। এক্ষেত্রে অন্যান্য শেয়ারহোল্ডাররা বিগত কয়েকবছর যাবৎ লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অপরদিকে, বিগত ২ বছর যাবৎ কোম্পানির দায়মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হচেছ না যার ফলে কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কেও অবহিত হওয়া যাচেছ না।
৫ বছর যাবৎ প্রিমিয়ামের অর্থ অনাদায়ী : কোম্পানির বিগত ৫ বছর যথা ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯,২০২০ ও ২০২১ সালে সালে ৪০ কোটি, ৫৫ কোটি, ৮৪ কোটি, ৭৭ কোটি ও ৬৮ কোটি টাকা প্রিমিয়াম বাবদ বকেয়া আয়ের অর্থ কোম্পানি সম্পত্তি হিসেবে হিসাবভুক্ত হয়েছে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো আদায় হয়না এবং অন্যদায়ী অংশ যথাযথ প্রক্রিয়ায় সমস্যা করা হয় না।
কোম্পানির বক্তব্য : প্রাইম ইসলালি লাইফের নানা অনিয়মের বিষয়ে প্রাইম ইসলামি লাইফের চেয়ারম্যান মোঃ আকতার এর মন্তব্য চাইলে বিজনেস পোস্টকে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখন কোন মন্তব্য দিতে পারবো না। পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হলে জানানো হবে।
তবে ২৮ নভেম্বরের সভায় প্রাইম ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোঃ আকতার কোম্পানির বর্তমান দুরাবস্থা ও আর্থিক অনিয়মের তথ্য স্বীকার করে বলেন, কোম্পানির অধিগ্রহণকালীন সময় থেকেই উত্তরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি বলেন, কোম্পানির সাবেক পরিচালকরা বিনিয়োগ বিধিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে বিনিয়োগ করেছেন। তাছাড়া, বিভিন্ন ব্যাংকে যে বিনিয়োগ ছিল এগুলো আমানত হিসেবে রেখে সেসকল বিনিয়োগের সমপরিমাণ অর্থ পরিকল্পিতভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে।
জমিতে বিনিয়োগ বিষয়ে তিনি সভাকে বলেন, জমির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অতিমূল্যায়িত করে জমি ক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। তাছাড়া পিএফআই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ বিষয়ে তিনি জানান, বিনিয়োগকৃত সম্পূর্ণ অর্থ লিয়োন রেখে পরিকল্পিতভাবে তছরূপ করা হয়েছে। এসকল বিষয়ে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে মামলা দায়ের করা হয়েছে মর্মে তিনি সভাকে জানান।