মোহাম্মদ নাহিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে আব্দুর রাজ্জাক সোহেল
অর্গানিক ফুড বা জৈব খাদ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষের মাঝে ক্রমশই বাড়ছে সচেতনতা। সেই সাথে এখন আরও বেশি সংখ্যক ভোক্তা ক্রয়ের আগে খোঁজ করেন, আসলে কোথা থেকে আসছে আর কীভাবেই বা উৎপাদিত হচ্ছে এসব পণ্য। এ কারণে, রাসায়নিক প্রয়োগ ছাড়া উৎপাদিত খাদ্য পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে।
রাসায়নিক প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবারের ছড়াছড়ির মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনরা পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অর্গানিক ফুডের দিকে ঝুঁকছেন, যদিও কীটনাশকমুক্ত পণ্যগুলোর দাম অন্য সবের চেয়ে বেশি।
সচেতন ভোক্তারা মনে করেন, অনেক নতুন স্টার্ট-আপসহ অর্গানিক খাদ্য প্রস্তুতকারীরা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের ব্যবসা বাড়াচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সারাদেশে ৩৭ হাজার ৪২২ মেট্রিক টন কীটনাশক ব্যবহার হয়েছে। এ ছাড়া, ২০১৩ সালে পরিচালিত পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের জরিপের তথ্যে বলছে, ৯৪ শতাংশ আম এবং ১০০ শতাংশ জাম ও লিচু ফরমালিনে ভেজানো হয়।
দ্য বিজনেস পোস্ট’র সাথে আলাপকালে অর্গানিক ফুডের ভোক্তা আরিফ সরদার বলেন, জৈব প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত পণ্য রাসায়নিক মুক্ত এবং এটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এছাড়া, এ জাতীয় খাবারগুলো অন্যসবের চেয়ে বেশি স্বাদের।
ই-কমার্স, এফ-কমার্স এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় প্রায় ১৫ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধি হচ্ছে এ ধরনের প্রাকৃতিক খাদ্যের।
এছাড়া, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পর পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের দিকে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ এসব পণ্যের বাজার বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে বাজারে শাকসবজি, ফল, দুগ্ধজাত, শুকনো শাকসবজি, ফলের রস, মাছ, তাৎক্ষণিক খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা পণ্য, শিশুর খাদ্য, সয়ামিল্ক, সয়া খাবার, খাদ্য পরিপূরক, পুষ্টি সম্পূরকসহ জৈব পণ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, জৈব চাষের জন্য প্রায় ২৮ হাজার ৪৯৪ একর জমি চাষাবাদ করা হচ্ছে; এছাড়া প্রায় ৬০০ সদস্য এ ব্যবসার সাথে জড়িত।
কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেড, অর্গানিক বাংলাদেশ লিমিটেড, শৈলী এগ্রো লিমিটেড, শামস এন্টারপ্রাইজ, চিতা অর্গানিক ফুডস, করতোয়া এগ্রো সার্ভিসেস, নর্দার্ন এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড, মামুন এগ্রো সার্ভিসেস লিমিটেড হলো এ বাজারের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, যারা নতুন এ প্রবণতায় ভালো করছে। তারা শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও প্রসারিত করছে এ ব্যবসা।
মুহিন অর্গানিক ফুডসের স্বত্বাধিকারী মো: মাহমুদুল হাসান বলেন, খাবারে রাসায়নিকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা ধীরে ধীরে অর্গানিক আইটেম খুঁজছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় স্নাতকও মুহিন আরও বলেন, বর্তমানে আমরা সাতটিরও বেশি জৈব আইটেম সরবরাহ করছি। এর মধ্যে, সরিষার তেল, ঘি, নারিকেল তেল নিয়মিত বিক্রি করছি। এছাড়া, আর কয়েকটি চাহিদা সম্পন্ন পণ্য রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতি মাসে আমরা প্রায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ লিটার সরিষার তেল এবং ১২০ থেকে ১৩০ কেজি ঘি বিক্রি করি।
অর্গানিক অনলাইন বাংলাদেশের অনলাইন এক্সিকিউটিভ রাকিবুল ইসলাম জানান, তারা মধু, ঘি, তেল, চাল, মশলাসহ ৩০০টি অর্গানিক পণ্য বিক্রি করছেন।
তিনি বলেন, আমাদের অর্গানিক পণ্যের চাহিদা প্রতি বছর ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ আমরা কঠোরভাবে জৈব মান নিশ্চিত করি।
রাকিবুল ইসলাম দাবি করেন, মূলত শিক্ষিত, স্বাস্থ্য সচেতন এবং ধনীরাই এ জাতীয় খাবারের প্রধান গ্রাহক।
মাইঅর্গানিকবিডি’র প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও মোহাম্মদ শরীফুল আলম পাভেল দাবি করেন, বর্তমানে তাদের অর্গানিক পণ্যের ব্যবসা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক ভালো, বাড়ছে চাহিদাও।
তিনি বলেন, আমাদের ফল ও মধু মূলত কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এগুলো বিদেশ থেকেও আমদানিকৃত।
অর্গানিক ফুডের ব্যবসায়ী রেজওয়ান চৌধুরী, যিনি কৃষাণ বাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বলেন, তারা তাদের ব্যবসাকে গ্রাহকদের জন্য একটি নিবেদিত পরিষেবা হিসাবে বিবেচনা করেন।
তিনি বলেন, আমাদের অর্গানিক ফুড স্টোর সুনামের কারণে ভোক্তাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বৃদ্ধির হার বার্ষিক ১০ শতাংশ। আমাদের ফিজিক্যাল স্টোর ছাড়াও আমরা অনলাইনে বিক্রি করি এবং সারা দেশেই পণ্য পাঠিয়ে থাকি।
অর্গানিক খাদ্যের মানদণ্ড
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, জৈব কৃষি হল একটি সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা, যা রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং জেনেটিকালি পরিবর্তিত জীবের ব্যবহার করে না; বায়ু, মাটি ও পানির দূষণ কমিয়ে দেয় এবং পরস্পর নির্ভরশীল সম্প্রদায় যেমন গাছপালা, প্রাণি ও মানুষের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতাকে ভালো করে।
সংস্থাটির আরও বলে, বাহ্যিক কৃষি উপকরণের অব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয় ঘটে (যেমন মাটির পুষ্টিগুণ) জৈব হিসেবে চিহ্নিত হয় না।
বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাকশন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের মতে, জৈব প্রক্রিয়ায় চাষের জন্য প্রধানত পাঁচটি মানদণ্ড প্রয়োজন। প্রথমত, জমিকে কমপক্ষে তিন বছর রাসায়নিকমুক্ত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, দশ মিটার জমি রাসায়নিকমুক্ত হতে হবে। তৃতীয়ত, সার হতে হবে পরিবেশ বান্ধব। চতুর্থত, সেচও নিরাপদ হওয়া উচিত। পঞ্চম, বীজ জৈব হতে হবে।
ক্রয় প্রবণতা বাড়ার কারণ
২০১৫ সালে রিসার্চগেটে প্রকাশিত, “বাংলাদেশে জৈব খাদ্য এবং বিভিন্ন গ্রাহকরা কীভাবে জৈব খাদ্য বাজারে প্রতিক্রিয়া জানায়” শিরোনামের গবেষণা তথ্য অনুসারে ব্যাখ্যা করেছে, লিঙ্গ, বয়স, শিক্ষা এবং আয়ের স্তর সবই জৈব খাদ্য কেনার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, জৈব খাবারের নিয়মিত ভোক্তারা উচ্চতর সামাজিক স্তরের, ধনী এবং শিক্ষিত।
অর্গানিক ফুড যাচ্ছে বিদেশেও
রাসায়নিক মুক্ত খাদ্যপণ্য আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশসহ বিশ্ব বাজারে বিশেষ স্থান পেয়েছে। প্রধানত কাজুবাদাম, চা, মিষ্টি আলু, মাছ এবং সয়াবিন, শাকসবজি ও ফলমূলসহ আরও কিছু পণ্য রপ্তানির তালিকায় রয়েছে।
অর্গানিক ফুড অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা আবদুস সালাম বলেন, তিনি আগামী বছর থেকে ৬৮০ কোটি টাকার কাজুবাদাম, সয়াবিন ও মিষ্টি আলু রপ্তানির জন্য জাপানি ক্লায়েন্টের সঙ্গে নতুন চুক্তি করেছেন।
কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আজবিনুর ইসলামের মতে, তারা প্রায় ১২টি দেশে গ্রিন টি রপ্তানি করছেন।
তিনি বলেন, আমরা জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ অব্যাহত রাখার কারণে দেশীয় এবং বৈশ্বিক উভয় বাজারেই আমাদের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।
গ্লোব নিউজওয়্যারের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী জৈব খাদ্য বাজারের মূল্য ছিল ১৬৭.৮৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৬ সালের মধ্যে এটি ৩৬৮.৯৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী অর্গানিক ফুজের বাজার মূলত রাসায়নিক বিষক্রিয়ার ক্রমবর্ধমান সংখ্যার কারণে বাড়ছে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনা বৃদ্ধি, খাদ্যে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের ক্ষতিকারক প্রভাব এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা, বিভিন্ন ভর্তুকির মাধ্যমে সরকারী সহায়তা এবং ক্রমবর্ধমান প্রবণতাও এসব পণ্যের চাহিদা বাড়াচ্ছে।
অর্গানিক ফুড কেন ?
রিসার্চগেটের তথ্য বলছে, জৈব খাবার স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমায়। কারণ, এতে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান বেশি থাকে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি রিসার্চ সার্ভিসের তথ্য পাওয়া গেছে, জৈব খাবারের ভোক্তাদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যের ধরণ রয়েছে। এ ধরনের খাদ্য গ্রহণ অ্যালার্জিজনিত রোগ এবং অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতার ঝুঁকি কমায়।
মাল্টিডিসিপ্লিনারি ডিজিটাল পাবলিশিং ইনস্টিটিউট পরিচালিত আরেকটি জরিপ একই পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল।
এতে বলা হয়, বন্ধ্যাত্ব, জন্মগত ত্রুটি, অ্যালার্জি সংবেদনশীলতা, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, বিপাকীয় সিনড্রোম, উচ্চ বিএমআই এবং নন-হজকিন লিম্ফোমাসহ জৈব খাবারের উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক ফলাফল রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডক্টর শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, সার ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য মানব স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
এ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন, আমাদের সারের ব্যবহার কমানোর দিকে নজর দিতে হবে এবং পরিবেশ বান্ধব সার ব্যবহার করতে হবে।
এ খাতের সামনে চ্যালেঞ্জ
যদিও এখানে অর্গানিক খাদ্যের বাজার ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হচ্ছে, এটির ওপর কোন নজরদারি নেই এবং অনেক অসাধু ব্যবসায়ী তাদের গ্রাহকদের সাথে প্রতারণাও করছে।
জৈব পণ্য উৎপাদনকারী, সংগঠক ও বিক্রেতারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। এছাড়া ভোক্তাদেরও এ ধরনের পণ্যের প্রতি আস্থার অভাব রয়েছে।
মুহিন অর্গানিক ফুডসের স্বত্বাধিকারী মোঃ মাহমুদুল হাসান বলেন, কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারণে ভোক্তারা মাঝে মাঝে প্রতারিত হয়।