প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

অস্বাভাবিক চাহিদায় ঊর্ধ্বমুখী ব্রয়লারের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৫ অক্টোবর ২০২১ ১৩:৪৯:২২ | আপডেট: ৩ years আগে
অস্বাভাবিক চাহিদায় ঊর্ধ্বমুখী ব্রয়লারের দাম

মিরাজ শামস

এক সময় ব্রয়লার মুরগি বিবেচিত হতো কম দামের প্রোটিনের উৎস হিসেবে। কিন্তু এখন সারা দেশের বাজারেই দাম বেড়ে এর প্রতি কেজি প্রায় ২০০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।

সম্প্রতি সরকার মুরগির খাবারের মূল উপাদান সয়মিলের রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। যদিও এ পদক্ষেপ ব্রয়লার মুরগির আকাশছোঁয়া দামের ওপর কোন প্রভাব ফেলেনি।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, ফার্মের মুরগির দাম সাধারণত বছরের এ সময়ে কম থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখন গত বছরের তুলনায় খাদ্যপণ্যটি বিক্রি করছেন ৪৮ শতাংশ বেশি দামে।

ক্রমবর্ধমান দামের বিষয়ে পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনা মহামারিতে এ খাতটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে হাজার হাজার খামারি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ায় খামার বন্ধ হয়ে গেছে।

এতে উৎপাদন কমে যাওয়ার বিপরীতে বর্তমানে ক্রেতাদের বাড়তি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। সেই সাথে পোল্ট্রি ফিডের দাম আগের বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এসব কারণেই ব্রয়লার মুরগির বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী।

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যাবধানে ঢাকার বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ খাদ্য পণ্যটি গত মাসে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় এবং আগস্টে প্রায় ৯৫ টাকায় বিক্রি হয়। সুতরাং মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ১০০ টাকা।

একইভাবে খামার পর্যায়েও দাম বেড়েছে। খামারিরা রোববার ফার্মের মুরগি ১৫০-১৫৫ টাকায় বিক্রি করছেন, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৪৫ টাকায়। 

অবশ্য, গত সপ্তাহে খামারিরা প্রতি কেজিতে ১০ টাকা দাম বাড়ালেও খামার এবং খুচরা দামের মধ্যে পার্থক্য এখন ৪০ টাকা। গত আগস্টে ১০ টাকা থেকে উল্লেখযোগ্য বেশি। এটি প্রমাণ করে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বেশি লাভ করতেই ফার্মের মুরগির দাম বাড়াচ্ছে।

দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং শিল্প মালিকরা জানান, করোনা মহামারির কারণে দফায় দফায় লোকসানের ফলে ৪০ শতাংশেরও বেশি পোল্ট্রি খামারি তাদের খামার বন্ধ করে দিয়েছেন।

খামারিদের একটি বড় অংশই এখনও তাদের পোল্ট্রি খামারগুলো পুনরায় চালু করেননি। এর মধ্যে কিছু খামারে এরই মধ্যে নতুন করে উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং যারা মহামারির বিরূপ প্রভাবের মধ্যেও টিকে ছিল, তারা এখন তাদের ক্ষতি পূরণের চেষ্টা করছেন।

কিন্তু কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে, ফলে খামারের মুরগির বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

দেশে উৎপাদিত ব্রয়লার মুরগির অর্ধেকই বাসা-বাড়িতে খাওয়া হয়। বাকি অংশ বিক্রি হয় সামাজিক এবং কর্পোরেট অনুষ্ঠান, হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। মহামারির মধ্যে চাহিদা অর্ধেকে নেমে গেলেও বর্তমানে উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায়, দামও বেড়েছে।

লকডাউন ও কঠোর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের পর গত দেড় মাসে ফার্মের মুরগির চাহিদা ধীরে ধীরে মহামারির পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে।

এ সময়ের মধ্যে মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করে। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো পুনরায় চালু হয় এবং এসব জায়গায় ফের সামাজিক এবং কর্পোরেট ইভেন্টগুলো চালু হয়। কিন্তু অন্যদিকে খামারের মুরগির উৎপাদন এ চাহিদার পূরণ করতে পারছে না।

লকডাউনের সময় ব্রয়লার মুরগির দাম খামারিদের উৎপাদন খরচের নিচে নেমে গিয়েছিল। তখন উৎপাদন খরচ ১০৫ টাকা হলেও, ব্যবসায়ীরা ডেকে ডেকে প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি করেছেন ৮০ টাকায়।

অনেক ক্ষুদ্র খামারী সেই সময়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে তাদের খামার বন্ধ করে দেয়, যা উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। একই কারণে ব্রিডার ফার্ম ও হ্যাচারিগুলো একদিন বয়সী বাচ্চার উৎপাদনও কমাতে বাধ্য হয়।

আগের মতো উৎপাদন কমে যাওয়ায় একদিন বয়সী বাচ্চার দামও এখন বেড়েছে।

বছরের এ সময়ে বাজারে সাধারণত ইলিশ এবং অন্যান্য দেশীয় মাছের একটি বড় সরবরাহ থাকে, যা মাছের দাম কমায়। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন, মাছের দামও এখন বেশ চড়া।

গরু ও খাসির মাংসের দামও অনেক বেশি, তাই ভোক্তারা তাদের নিয়মিত খাদ্যতালিকায় প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ব্রয়লার মুরগি কিনছেন। এসব কারণেই ফার্মের মুরগির চাহিদা এখন আকাশচুম্বী।

প্রাণিসম্পদ বিভাগ এবং বিপিআইসিসি’র তথ্য বলছে, দেশের পোল্ট্রি সেক্টর মহামারির আগে প্রতি মাসে প্রায় ৯০ হাজার টন মাংস সরবরাহ করত। কিন্তু গত দেড় বছরে এর উৎপাদন ৪০-৪৫ শতাংশ কমেছে।

বাংলাদেশে ৯০ হাজার নিবন্ধিত পোল্ট্রি খামারি রয়েছেন। এ শিল্পের নেতারা বলছেন, দেশে এক লাখেরও বেশি পোল্ট্রি খামার রয়েছে।

খাদ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামও দায়ী

মুরগির খাবারের মূল উপাদান ভুট্টা, সয়ামিল, গম, ময়দা, ভাঙা চাল, ধানের ভুষি, মাছের মাংস, খৈল, ভোজ্য তেল, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপাদান হলো ভুট্টা (৫০ শতাংশ) এবং সয়ামিল (৩০ শতাংশ)।

গত কয়েক বছর ধরেই দেশে যে পরিমাণ ভুট্টা উৎপাদন হচ্ছে, তা বার্ষিক চাহিদার প্রায় অর্ধেক। কিন্তু সয়াবিনের চাহিদা পূরণের জন্য আমদানির ওপর প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভর করে বাংলাদেশ। খামারের মুরগির উৎপাদন খরচের প্রায় ৭৫ শতাংশই খাদ্যে চলে যায়।

খাবারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ফার্মের মুরগির দামও।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মো: আনোয়ারুল হক বেগ। তিনি বলেন, পোল্ট্রি ফিডের অধিকাংশ কাঁচামাল এবং প্রায় সব সংযোজিত উপদানই আমদানি নির্ভর।

করোনা মহামারির কারণে এ উপাদানগুলোর দাম বেড়েছে এবং এটি খামারের মুরগির দাম বাড়িয়েছে।

শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছর প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির খাবারের দাম ছিল প্রায় ৪৫ টাকা, যা এখন ৫৫ টাকা। মুরগির খাবারের কাঁচামালের মধ্যে ভুট্টা এবং অন্যান্য পণ্যের মূল্যও বেড়েছে, যা খাদ্য উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে ৩৪ শতাংশ।

এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও খাদ্যের দাম মাত্র ৭ শতাংশ বেড়েছে বলে দ্য বিজনেস পোস্ট’কে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান এহতেশাম বি শাহজাহান।

তিনি আরও বলেন, সয়ামিল রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হলেও দেশীয় উৎপাদকরা দাম খুব একটা কমায়নি। রপ্তানির আগে প্রতি কেজি সয়ামিলের দাম ছিল ৩৫ টাকা, কিন্তু রপ্তানি শুরু হলে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ টাকা কেজিতে। এখন প্রতি কেজি সয়ামিল ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আর এর প্রভাব পড়ছে খাবারের দামে।

এহতেশাম বি শাহজাহান জানান, বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পোল্ট্রি ফিড উপাদানের সিংহভাগ আমদানি করে। শিপিংয়ের উচ্চ খরচ, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য রিসেল করার ক্ষেত্রে জটিলতা, ল্যাব টেস্টিংয়ের সমস্যা এবং বিলম্ব চার্জ মুরগির খাবারের দাম বাড়িয়ে দেয়।