প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

আচারের বাৎসরিক বাণিজ্য ২০০ কোটি টাকা

রোকন উদ্দীন
১৫ অক্টোবর ২০২২ ১৬:২৮:২৪ | আপডেট: ২ years আগে
আচারের বাৎসরিক বাণিজ্য ২০০ কোটি টাকা

একসময় ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের হাতে তৈরি আচার পরিচিতজনের কাছে বিক্রি হলেও এখন তা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি বড় বড় শিল্প গ্রুপ এ খাতে হাত বাড়ানোয় দেশে আলাদা একটি শিল্পখাত গড়ে ওঠেছে। প্রাণ, স্কয়ার, বিডি ফুডসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে দেশের আচার রপ্তানি হচ্ছে বাইরেও।

গত দেড় দশকের পথ পেরিয়ে বর্তমানে বছরে ২০০ কোটি টাকার বেশি আচার উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে দেশে। কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এ খাতে প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা আর ১৫-২০ শতাংশ হারে বাড়ছে বাজার।

*জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আচার রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত ক্রেতারাই ব্র্যান্ড আচারের ক্রেতা। তারা আচার কেনার ক্ষেত্রে বিএসটিআই’র মানসনদ আছে কিনা এবিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের কাঁচের বয়ামে বিক্রি হওয়া আচারই কিনে থাকেন বেশি।

বিভিন্ন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে বছরে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার টন আচার উৎপাদন ও বিপণন হয়। যার বাজার মূল্য ২০০ কোটি টাকারও বেশি। এই বাজারের সিংহভাগ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে। উদ্যোক্তাদের হিসেবে বছরে ১৬০-১৭০ কোটি টাকার আচার উৎপাদন ও বিপণন করে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের হিসেবে প্রতি বছর ১৫-২০ শতাংশ হারে বাড়ছে দেশীয় আচারের বাজার। মূলত ২০০৫ সালের পর থেকে অধিকাংশ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে বিনিয়োগ করায় আচারের বাজার বড় হতে থাকে।

*শতভাগ দেশীয় কাঁচামালের উপর নির্ভর

এ শিল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো প্রায় শতভাগ দেশীয় কাঁচামালের উপর নির্ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে এ খাতটি। কারণ দেশীয় আম, বরই, তেতুল, চালতা, জলপাই, রসুন, মরিচসহ বিভিন্ন প্রকার ফল আচারের প্রধান উপকরণ। এছাড়া সরিষার তেলসহ অন্যান্য উপকরণও দেশেই উৎপাদন হয়। শুধু আলুবোখারাসহ কয়েকটি পণ্য আমদানি করতে হয়, তাও খুবই সামান্য। কারণ আলুবোখারার আচারের পরিমান বাজারে এখনও জনপ্রিয় হয়নি।
দেশীয় কাঁচামালে উৎপাদিত এসব আচার শুধু দেশের বাজারেই বিক্রি হয় না, রপ্তানিও হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে।

স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (মার্কেটিং) এম এ মাহমুদ বিজনেস পোস্টকে বলেন, আচার এমন একটি মুখরোচক খাদ্যপণ্য যা সব বয়স ও শ্রেণীর মানুষেরই পছন্দ। আচারে পুষ্টিগুণ যেমন রয়েছে তেমনি মুখের রুচি ও খাদ্যের স্বাদ বাড়াতে সহায়তা করে। তাই এ খাতের বাজার দিন দিন বাড়ছেই।

তিনি বলেন, স্কয়ার ২০০৫ সালে আচার উৎপাদনে আসার পর গড়ে ১৫ শতাংশের বেশি হারে এর বাজার বাড়ছে। বর্তমানে আমাদের ছয় ধরণের ৪০০-৪৫০ মেট্রিক টন আচার উৎপাদন ও বিপণন হয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানিও হচ্ছে আমাদের আচার। মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরাই এসব আচারের ক্রেতা।

তিনি আরও বলেন, কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে- যেমন আম, জলপাইসহ আচারের প্রধান কাঁচামালগুলো মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় এগুলো বছরজুড়ে সংরক্ষণ করতে হয়। এছাড়া আচারের বাণিজ্যে খুব একটা সমস্যা নেই। ভবিষ্যতে এই বাজার আরো অনেক বড় হবে।

*কোন ব্র্যান্ডের আচারের কত দাম

বাজার ঘুরে দেখা যায়- প্রাণ, স্কয়ার (রুচি), এসিআই, বিডি ফুড, আহমেদ ফুড, এ্যাকমি, আফিয়া, কিশান, খুশবু, কাশফুডসহ ১৫-২০টি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান আচার বাজারজাত করছে। এগুলোর অধিকাংশই কাচের বয়াম বা জারে ২০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

বিক্রেতারা বলছেন, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ৪০০ গ্রামের জারগুলো। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই টক, মিষ্টি ও জাল স্বাদের কমপক্ষে ৫-৬ ধরণের আচার পাওয়া যায়। এছাড়া করো কারো ১০ রকমের আচারও রয়েছে বাজারে। এর মধ্যে আম, জলপাই, বড়ই, চালতা, মরিচ, রসুন, সাতকড়া, আলুবোখারা ও মিক্সড আচার জনপ্রিয় বেশি। এছাড়াও আমলকি, লেমন ও কতবেলসহ আরো ৫-১০ ধরণের আচার বাজারে পাওয়া যায়।

বিভিন্ন দোকান, সুপারশপ ও ভ্রাম্যমাণ দোকানে চালতা, বরই, জলপাইসহ কিছু ফলের খোলা আচারও পাওয়া যায়। এছাড়া অনেক ছোট উদ্যোক্তা আচার তৈরি করে পরিচিত জন কিংবা অনলাইনে বিক্রি করে থাকেন। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিক্রি হওয়া কর্পোরেট ব্র্যান্ডের আচারের দাম তুলনামূলক কিছুটা বেশি।

রাজধানীসহ ছোট-বড় প্রায় সব বাজারেই আচার পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সুপারশপগুলোতে। এছাড়া অনেক বাজারে আচারের আলাদা করে দোকানও দেখা যায়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিভিন্ন মেলাতেও আচারের পসরা সাজিয়ে বসেন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা।

বাজারে বিক্রি হওয়া আম ও জলপাইয়ের ৪০০ গ্রাম আচারের দাম ব্র্যান্ড ভেদে ১৩০-১৫০ টাকা, আমের আচারের এক কেজির জারের দাম ৪০০ টাকা পর্যন্ত রাখা হয়। রসুনের আচারও বেশ জনপ্রিয়, প্রতিটি ৪০০ গ্রাম আচারের জারের দাম ১৮০-২১০ টাকা। বরই’র আচারের জনপ্রিয়তাও তুলনামূলক কম নয়, প্রতিটি ৩৫০ গ্রামের জারের দাম ১২০-১৩০ টাকা। এছাড়া ৪০০ গ্রামের আলুবোখারর আচারের জার ৩০০-৩৫০ টাকা, চালতা, চিলি ও আমলকিসহ অন্যান্য আচারের ৪০০ গ্রামের জার বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৬০ টাকায়। এসব আচারের এক কেজির জার বিক্রি হয় ৪০০-৫০০ টাকায়।

*ক্ষুদ্র উদ্যোগে প্রতিবন্ধকতা

আচারের বাজার বড় হলেও এর কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরিতে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এখাতে। বাজারজাতকরণ, লাইসেন্সপ্রাপ্তিসহ কয়েক ধরণের প্রতিবন্ধকতায় অনেক ছোট উদ্যোক্তা শুরুতেই ঝড়ে পড়ছেন বলে জানা যায়।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আচার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার পেয়েছেন উদ্যোক্তা ফারহানা ফারুক নাজ। তিনি রাজশাহীর কুকিং গার্ডেন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী।

বিজনেস পোস্টকে তিনি বলেন, বিএসটিআই’র বড় অংঙ্কের লাইসেন্স ফি'সহ নানা আনুষ্ঠানিকতা থাকায় আমাদের মতো ছোট উদ্যোক্তাদের অনেকেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারেন না। এছাড়া উৎপাদনের কাঁচামালগুলো সংরক্ষণে সমস্যা ও উৎপাদিত পণ্যগুলো বাজারজাত করাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুই সমস্যায় পড়ে অনেক উদ্যোক্তাই ঝড়ে পড়েন।

তিনি বলেন, আমি ২০১০ সাল থেকে আচার তৈরি করি। ২০১৪ সালে ক্ষুদ্রপরিসরে আচারসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের ব্যবসা শুরু করেছি। একসময় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আচার উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েও ফিরে এসেছি। এখন কেউ অর্ডার দিলে তৈরি করে দিই।