মেহেদী আল আমিন
আমদানির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতার কারণে সাশ্রয়ী মূল্যে হুইলচেয়ারের অভাবই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরও বেশি অসহায় করে তুলছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ শারীরিক প্রতিবন্ধী যাদের অসুস্থতা, আঘাতজনিত সমস্যা, বার্ধক্যজনিত সমস্যা বা শারীরিক প্রতিবন্ধকার কারণে হাঁটাচলা করা কঠিন বা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, তারা একটি হুইলচেয়ারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এর মধ্যে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি , সেরিব্রাল পলসী, মস্তিষ্কের আঘাত, মোটর নিউরোন আক্রান্ত, পেশীবহুল ডিসস্ট্রোফি, স্পিনা বিফিডা এবং আরও অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
প্রতিবছর ব্রেইন স্ট্রোক, সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য কারণে শত শত মানুষ শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম হওয়ায় বাংলাদেশে হুইলচেয়ারের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে।
আমদানিকারক পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বর্তমানে কম লাভের কারণে এই চিকিৎসা সামগ্রীটি তারা আর আমদানি করতে আগ্রহী না। সেজন্য গত ৪ থেকে ৫ মাস যাবত হুইলচেয়ারের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা পন্যটির দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়া বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য স্থানীয় কোনো কোম্পানি না থাকায় দেশ এখন চীনের তৈরি হুইলচেয়ারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।
বাড়তি শিপিং ব্যয়ের পাশাপাশি হুইলচেয়ারের দাম চীনে বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, তাই দেশীয় বাজারে আমদানি করা হুইলচেয়ারগুলোর ঘাটতি এখন এতটাই মারাত্মক যে এই চেয়ারগুলোর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
রামপুরার বাসিন্দা আবদুল ওয়াহাব, ছয় মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানো ছোট ভাইয়ের জন্য হুইলচেয়ার কিনতে জাতীয় ট্রমাটোলজি অ্যান্ড আর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন সংস্থার পাশে আগারগাঁওয়ের একটি মেডিকেল সরঞ্জামের দোকানে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “ছয় মাস আগে আমার ভাইকে কাছের একটি হাসপাতালে ভর্তি করার সময় এক দোকান মালিক আমার কাছে একটি হুইলচেয়ারের দাম চেয়েছিলেন ৪ হাজার টাকা। শুধুমাত্র বেশি দামের জন্য আমি আমার হুইলচেয়ারটি কিনতে পারিনি। কারণ সে সময় আমার হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিলো না। যেহেতু হুইলচেয়ার এখন তার দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে এবং এটি ছাড়া সে চলতেও পারে না তাই আমি আজ এই চেয়ারটি ৫ হাজার ২০০ টাকায় কিনেছি।
রাজধানীর পল্টন এলাকার বিক্রয়কর্মী শরীয়তপুর সার্জিক্যালের সত্ত্বাধিকারী দীন ইসলাম বলেন, "আমরা হুইলচেয়ার সরবরাহের জন্য খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে আগেই টাকা নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সে অনুযায়ী আমরা হুইলচেয়ার সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই আমরা টাকা ফেরত পাঠিয়েছি।"
তিনি আরও বলেন, “বিক্রেতারা একটি হুইলচেয়ার বিক্রি করে কেবল ৫০ টাকা আয় করতে পারে। আমদানিকারকরা সাপ্লাই চেইন বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন এমন সময়ে ৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে কেবল ৫০ টাকা উপার্জন করা মোটেও ফলপ্রসূ ব্যবসা নয়। এ সমস্ত জিনিস একসাথে হুইলচেয়ারের ঘাটতি এবং এর ফলস্বরূপ দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী।’’
আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের জন্য অন্যতম হুইলচেয়ার বাজার হলো আজিজ কো-অপারেটিভ মেডিসিন এন্ড মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মার্কেট। এই বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, কেবলমাত্র একটি দোকান জিতু এন্টারপ্রাইজে মাত্র দুটি হুইলচেয়ার বিক্রি করতে দেখা গেছে।
জিতু এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী মাহফুজুর রহমান মোল্লা বলেন, “ক্রেতারা হুইলচেয়ার চাইলেও আমরা খুব কম লাভের কারণে এখন বিক্রি করিনা। সরবরাহকারীরাও আজকাল এ পন্যটি আমদানি করতে আগ্রহী নন এবং বাংলাদেশেও এ বিষয়ে বিনোয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না কেউেই।”
আজিজ কো-অপারেটিভ মেডিসিন এন্ড মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মার্কেটের চিকিৎসা সরঞ্জামের আমদানিকারক অপু হোসেন বলেন, “অন্যান্য ঝামেলা ছাড়াও আমদানির সময় জাহাজে হুইলচেয়ারগুলোর জন্য বেশি জায়গা প্রয়োজন এবং এমনকি গুদাম এবং খুচরা বাজারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।”
তিনি বলেন, “তাছাড়া চীনে হুইলচেয়ারের দাম ১৫ শতাংশ বেড়েছে। সুতরাং আমরা হুইলচেয়ার আইটেমকে আমাদের আমদানি তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি”।
১২৫ কোটি টাকার হুইলচেয়ারের বাজার
দেশে বার্ষিক ২,৫০,০০০ এরও বেশি হুইলচেয়ারের প্রয়োজন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্ট্রোক থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির জন্য হুইলচেয়ারের প্রয়োজন বেশি হয়। এর পরে অর্থোপেডিকস রোগী এবং সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়াদের।
হাসপাতালের নিজস্ব অধ্যয়নের কথা উল্লেখ করে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, "স্ট্রোকের কারণে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের হুইলচেয়ারের প্রয়োজন হয়।"
তিনি আরও বলেন, “প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০০ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এভাবে বাংলাদেশে আনুমানিক ১০০ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৯ লাখ মানুষ স্ট্রোকের শিকার হন। এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হাটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহার করে। প্রতি বছর কমপক্ষে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের হুইলচেয়ারের প্রয়োজন হয়।”
তিনি আরও বলেন, "স্ট্রোকের রোগী ছাড়াও অসংখ্য মাথা ও মেরুদন্ডে জখম হওয়া রোগীরাও অক্ষম হয়ে পড়েন এবং তাদের হুইলচেয়ারের প্রয়োজন হয়।”
ন্যাশনাল ট্রমাটোলজি অ্যান্ড আর্থোপেডিক পুনর্বাসন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, হাসপাতালে ধীরে ধীরে রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৫ সালে হাসপাতালে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩০৩ জন রোগী চিকিৎসা করিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ৩৪ জনে পৌঁছেছে।
এর মধ্যে ৩১ হাজার ৩১৫ জনকে তাদের চিকিৎসার জন্য অপারেশন থিয়েটারে যেতে হয়েছিল। ২০১৫ সালে অপারেশন করা রোগীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৭ হাজার ৯২০ জন।
নিটোর পরিচালক ডাঃ মোঃ আবদুল গণি মোল্লা বলেন, "যে রোগীদের অপারেশন করা দরকার তাদের মধ্যে ১-৫ শতাংশ উভয় পা হারাতে পারেন। তাদের হুইলচেয়ার দরকার। যারা প্রায় ৮০ বছর বয়সী তাদের অনেকেরই এমন অপারেশনের পরে হুইলচেয়ারের প্রয়োজন হয়"।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি দাবি করেছে যে, ২০২০ সালে কেবল সড়ক দুর্ঘটনার কারণে ৬ হাজার ৮০০ জন আহত হয়েছিল।
সারা দেশে ২ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি হুইলচেয়ারের চাহিদার বিপরীতে খুচরা বিক্রেতাদের দোকানে হুইলচেয়ারের গড় বাজারমূল্য প্রায় ৫০০০ টাকা। যার জন্য সারাদেশে মোট বাজারের আকার প্রায় ১২৫ কোটি টাকা ধরা হয়।
আমাদের দেশে উৎপাদন কেন হয় না
আমদানিকারক ও সরবরাহকারি নাসির উদ্দিন স্থানীয়ভাবে হুইলচেয়ার তৈরির জন্য একটি কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জটিলতার কারণে তিনি হাল ছেড়ে দেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দ্য বিজনেস পোস্ট'কে বলেন, “হুইলচেয়ার আমদানিতে শুল্ক বা ভ্যাট নেই এবং কাঁচামাল আমদানিতে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। সুতরাং স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশে উৎপাদন লাভজনক হবে না। এটি আমদানিকৃত হুইলচেয়ারগুলোর চেয়েও ব্যয়বহুল হবে"।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা কত?
অধিকার ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আইন ২০১৩ পাস হওয়ার সাত বছরেরও বেশি সময়ের পরেও এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অস্পষ্ট।
সমাজসেবা অধিদপ্তর (ডিএসএস) ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবন্ধী সনাক্তকরণ সমীক্ষা চালায়। ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫৭ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চিহ্নিত করা হয়। এটি মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.১৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা জানান, তথ্যটি দেশে প্রতিবন্ধীদের সঠিক সংখ্যা প্রতিফলিত করে না। ডেটা সহ নির্ভরযোগ্যতা এবং বৈধতা সম্পর্কিত সমস্যাও রয়েছে।
এদের মধ্যে ১৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৯৪ জন পুরুষ যা মোট জনসংখ্যার ৬১ শতাংশ, এবং ৮ লাখ ২৩ হাজার ৮৫৫ জন মহিলা, যা ৩৮ শতাংশ। ট্রান্সজেন্ডারদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা আছে এক শতাংশের মধ্যে, যার সংখ্যা ২ হাজার ৬০৮ জন। মোট জনসংখ্যার ২১ দশমিক ৭২ শতাংশের মধ্যে ডিএসএস ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯৩ জন প্রতিবন্ধী শিশুদের সনাক্ত করেছে।
প্রতিবন্ধীদের প্রায় ২০ শতাংশ ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ফেনী, নোয়াখালী, চাটোগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা প্রভৃতি উপকূলীয় দূর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোতে বসবাস করে।
কুমিল্লা জেলায় সর্বাধিক সংখ্যক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে সর্বনিম্ন সংখ্যা পাওয়া গেছে।
বান্দরবান জেলায় ৫ হাজার ৯৭২ জন জন প্রতিবন্ধী রয়েছে যা সমস্ত জেলার মধ্যে প্রতিবন্ধীদের সর্বনিম্ন ঘনত্ব। খাগড়াছড়ি (১২ হাজার ৩৬৪) এবং রাঙ্গামাটি (৯ হাজার ৯৩০) এই জেলার মধ্যে সবচেয়ে কম প্রতিবন্ধী রয়েছে।
২০১১ সালে প্রকাশিত প্রতিবন্ধী সম্পর্কিত ডব্লিউএইচও রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ১৬ মিলিয়ন প্রতিবন্ধী ছিল। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত গৃহস্থালী আয় এবং ব্যয় জরিপ (এইচইএস) বলেছে, যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৯.১ শতাংশের মধ্যেই কোন না কোন প্রতিবন্ধিতা রয়েছে।
এইচইএস প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কার্যকরী সীমাবদ্ধতার উপর ভিত্তি করে এবং অক্ষমতা সনাক্তকরণের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ওয়াশিংটন গ্রুপের প্রশ্নগুলো অনুসরণ করেছিল।