প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

আর্থিক সংকটে বেজা

মিরাজ শামস
১১ জুলাই ২০২৩ ১৮:০৯:১৯ | আপডেট: ২ years আগে
আর্থিক সংকটে বেজা

আর্থিক সংকটে পড়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বেজা) উন্নয়ন গতি পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আয় বাড়াতে পারেনি দেশের শিল্পখাতের উন্নয়নে জোরেসোরে উদ্যোগ নেওয়া এ সংস্থাটি।

বেজার আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। এতেই আর্থিক হিসাবে দেখা দিয়েছে বড় ঘাটতি। এ কারণে ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময়ে চেয়েছে। বেজার যাত্রা শুরুর গত এক যুগ পর এমন আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন শিল্পে আশা জাগানো এ কর্তৃপক্ষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন বাস্তবায়নে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। মূলত বেজার আয়ের বড় অংশ নির্ভর করে অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি লিজ থেকে পাওয়া অর্থের উপর। নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এই আয়ে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণেই ক্রমাগত সংকটে পড়েছে।

সূত্রে জানা যায়, কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মন্দার কারণে নতুন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ হচ্ছে না। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কারণে অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরাও লিজ মানি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধে সক্ষম হচ্ছে না। অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাতিল ও স্থগিত করায় বেজার কাছে জমা থাকা আর্নেস্ট মানি ও লিজ মানি ফেরত নিয়েছে। এর ফলে জমি লিজের অর্থ থেকে অন্যতম আয়ের পথটি এখন সংকুচিত হয়েছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে শিল্প স্থাপন না হওয়ায় গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সেবা থেকে সার্ভিস চার্য আদায় করে আয় বাড়াতে পারছে না বেজা।

কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটের যে প্রভাব অর্থনৈতিক অঞ্চলে পড়েছে বেজার বার্ষিক প্রতিবেদনেও একই অবস্থা দেখা যায়। ২০২০ সাল পর্যন্ত বেজার ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৬৮টি বিনিয়োগকারীকে ৮,০০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ছিল ২৪.৫২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এই বিনিয়োগ উল্টো কমেছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত ওই ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৩৭টি বিনিয়োগকারীকে ৫,৭৮০ একর জমি ইজারা অব্যহত রাখা হয়েছে। তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ২১.২ বিলিয়ন ডলার। ফলে এক বছরের ব্যবধানে অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩১ বিনিয়োগকারী কমেছে। বিনিয়োগকারী চলে যাওয়ায় বিনিয়োগ প্রস্তাবিত বিনিয়োগ কমেছে ৩.৩২ বিলিয়ন ডলার। তবে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয় এবং ২০২১ সালে তা বেড়ে ৩.৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

বেজা বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন কাজের জন্য বিভিন্ন সময়ে অর্থ বিভাগ থেকে ঋণ নিয়েছে। চলতি অর্থ বছরে অর্থ বিভাগ অনুমোদিত বেজার বাজেটে ১০৫৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এই ব্যয়ের বিপরীতে বেজার নিজস্ব আয়ের উৎস খুবই সীমিত। আয় কেবল মাত্র ৩২৭.৪৯ কোটি টাকা। বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি বিনিয়োগকারীদের কাছে লিজ দিয়ে পাওয়া অর্থ অবার অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অর্থ বিভাগের লোন এগ্রিমেন্ট ও সাবসিডিয়ারি লোন এগ্রিমেন্ট বিপরীতে বেজার কাছে বকেয়া পাওনা সুদাসল ১৩১ কোটি টাকা। বেজার কাছে এই টাকা চেয়েছে অর্থ বিভাগ। বেজা অর্থবিভাগকে জানিয়েছে, নানা কারণে আয় বৃদ্ধি করতে না পারায় বকেয়া পরিশোধের জন্য বেজার তহবিলে প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থ বিভাগ থেকে নেওয়া ঋণ ও সুদের অর্থ পরিশোধ করা হলে বেজার চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম ও বিনিয়োগ উদ্যোগ ব্যাহত হবে। এতে বিনিয়োগ পরিবেশ ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী ৫ বছরের জন্য অর্থ বিভাগ থেকে নেওয়া ঋণ ও সুদ পরিশোধ থেকে বেজাকে অব্যহতি দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

অর্থ বিভাগের সঙ্গে ৭টি ঋণ চুক্তির বিপরীতে পাওনা ১৩১ কোটি টাকা চেয়েছে। তবে বেজা বলছে, জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে দুটি প্রকল্পের ঋণ নিয়েছে। অর্থ বিভাগের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী এই দুই প্রকল্পের ক্ষেত্রে গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর। এর ফলে ২০৩০ সালের জুনে এই ঋণের প্রথম কিস্তি দিতে হবে। তা সত্ত্বেও ওই দুটি ঋণের কিস্তি ২২.৪৯ কোটি ও ৫৪.১১ কোটি টাকার মতো। ফলে এই দুটি ঋণের কিস্তির পরিমাণ ৭৬.৬১ কোটি টাকা। এই অর্থ বাদ দিলে বকেয়া পাওনা ৫৪.৪৮ কোটি টাকা।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে বলেছেন, অর্থ বিভাগের সঙ্গে সই করা ঋণ চুক্তির বিপরীতে বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য বেজার তহবিলে প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। এমন পরিস্থিতি বর্তমান আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে এই ঋণ পরিশোধের জন্য এখন থেকে ৫ বছর বাড়তি সময় দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন বেজা।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন ২০১০ সালে পাস হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সংস্থার মূখ্য কার্যাবলীর মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, লাইসেন্স প্রদান, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ করা। বেজা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান ও ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। বর্তমানে অনুমোদিত ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ২৮টি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল উৎপাদনশীল রয়েছে। বেজার নিজস্ব জমির পরিমাণ ৬১,০০০ একর। ২০৩০ সালের মধ্যে বেজার ল্যান্ড ব্যাংকে ৭৫,০০০ একর জমি অন্তভূক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।