প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

আর্থিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় আসছেন আইএমএফ প্রতিনিধিদল

হাসান আরিফ
২৫ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫৭:৫৭ | আপডেট: ২ years আগে
আর্থিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় আসছেন আইএমএফ প্রতিনিধিদল

অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংস্কার এবং নীতি নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে আসছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল।

বুধবার ঢাকায় পৌছানোর কথা রয়েছে প্রতিনিধি দলটির।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএমএফ জানিয়েছে, ২৬শে অক্টোবর থেকে ৯ই নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংস্কার এবং নীতি নিয়ে আলোচনা করবেন আইএমএফ প্রতিনিধিদল।

এদিকে টাকার সাথে ডলারের বিনিময় হার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করায় ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়-ব্যায়ের ভারসাম্য। পরিস্থিতি সামাল দিতে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ স্থিতিশীল রাখতে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ ঋণ।

জানা যায়, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতি তৈরি হলে আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয় ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যখন কোন দেশ ঘাটতিতে পড়ে, বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষত ডলারের ঘাটতি তৈরি হয় তখন আইএমএফ ঋণ দিয়ে থাকে।

যেসব কারণে আইএমএফের ঋণ

রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়া এবং রপ্তানি আয়ের তুলনায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি অতিতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নিয়েও জটিলতায় দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিমাসে ১২০ কোটি ডলার বাজারে ছাড়ছে বাংলাদেশে ব্যাংক। এর ফলে কমছে রিজার্ভ।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার শুধু আইএমএফের কাছেই ঋণ চাইছে না, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জাইকার সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

আইএমএফের ঋণ পেলে এসব সংস্থার ঋণ পাওয়া সহজ হবে বলে দাবি করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

আলোচনায় স্থান পেতে পারে যেসব শর্ত-সুপারিশ

আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে সরকার।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ দিতে যদি আইএমএফ কোন শর্তের জালে আটকাতে চায় তাহলে বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা/বর্ধিত তহবিল সুবিধা ও স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই সুবিধা (আরএসএফ)-এর অধীনে এক বিলিয়ন ডলার নেয়া হবে। যা সাধারণভাবেই এইএমএফ দিয়ে থাকে।

সর্বশেষ গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ বিষয়ে আইএমএফ স্টাফ ও এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টরের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আর্থিক ও অর্থনৈতিক খাতে বেশ কিছু সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশের রাজস্ব ও কর নীতির সংস্কার করা, বিশেষ করে রাজস্ব বাড়ানো, সেজন্য ব্যয়ভার সীমিত করতে হবে এবং ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থায় আমানত ও ঋণের যে সীমা বেধে দেয়া আছে, সেটা তুলে দিতে হবে। মুদ্রানীতির আধুনিকায়ন করা ও মুদ্রাবাজারের ওপর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া। রিজার্ভ যথেষ্ট থাকলেও সেটা সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া এবং সতর্ক থাকা। দেশের বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমিয়ে আনা।

এছাড়াও রয়েছে ব্যাংকিং খাতে বিধিমালার কঠোর বাস্তবায়ন ও নজরদারি জোরালো করা। বিশেষ করে আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে যেন খেলাপি ঋণ হ্রাস পায়।

একইসঙ্গে আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করে তুলা। করোনাভাইরাসের সময়কার খরচের নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হলেও সেটা প্রকাশ করা উচিত। রপ্তানির বহুমুখীকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পদক্ষেপ নেয়া, উৎপাদন বাড়ানো, মানব সম্পদের উন্নয়ন ও দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।

জলবায়ু পরিবর্তনে পদক্ষেপ ও তহবিল বরাদ্দে সংস্কার কার্যক্রমেরও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এর বাইরে ব্যাংক খাতের বর্তমান আমানত ও ঋণে যে ৬-৯ শতাংশ সুদের হার রয়েছে, সেটা তুলে দিতে বলতে পারে। এর দ্রুত বাস্তবায়ন চাইতে পারে সংস্থাটি।

ধারণা করা হচ্ছে, আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এবারের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে এসব সুপারিশ বা শর্ত।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফ যেসব শর্ত দেবে, তার অনেকগুলো বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছুটা সময় দেওয়া হবে। রাজস্ব খাতের সংস্কারেও হয়তো তিন বা চার বছর সময় পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশকে দেয়া আইএমএফের যত ঋণ ও যত শর্ত

আইএমএফের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে ঋণের জন্য সবচেয়ে বেশি সংস্থাটির দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এই ১০ বছরে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে পাঁচ বার অর্থ ঋণ নিয়েছে।

আইএমএফ যখনই বাংলাদেশকে কোন ঋণ দিয়েছে তখনই তারা কিছু শর্ত বা সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। এসব শর্তের কিছু বাংলাদেশে মেনে নিয়েছে আবার কিছু মেনে নেয়নি।

ঋণের ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে আইএমএফের বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। যার কারণে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর চালু করা হয়। এছাড়া বাণিজ্য উদারীকরণ, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের শর্তও ছিল। যার সাথে বিশ্বব্যাংকও জড়িত ছিল।

১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে কোনো ঋণ নেয়নি।

২০০৩ সালে ফের বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে থেকে ঋণ নেয়। সেবার বড় শর্ত ছিল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমিয়ে আনতে হবে। তখন আইএমএফের শর্ত মেনে আদমজী পাটকল বন্ধ করে সরকার।

সর্বশেষ ঋণ ২০১২ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। এসময় ট্যাক্স পলিসির ক্ষেত্রে কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সে সময় নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া মুদ্রার বিনিময় হার এবং সুদের হার নির্দিষ্ট করে তা কৃত্রিমভাবে ধরে না রেখে বাজারের উপর ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ।