প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

ইভ্যালির পথেই আরও ১০ ই-কমার্স, কয়েক মালিকের দেশত্যাগ

০১ অক্টোবর ২০২১ ১১:৩২:৩৩ | আপডেট: ৩ years আগে
ইভ্যালির পথেই আরও ১০ ই-কমার্স, কয়েক মালিকের দেশত্যাগ

মিরাজ শামস

গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং অর্থ পাচারের পর বেশ কিছু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মালিক বিদেশে পালিয়ে গেছেন, স্বরাষ্ট্রসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে এমনটাই জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

গত ২২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ এবং ধামাকা শপিং ছাড়াও আরও ১০ টি ই-কমার্স কোম্পানি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

কোম্পানিগুলো হলো- আলেশা মার্ট, ফাল্গুনী শপ, সিরাজগঞ্জ শপ, টোয়েন্টিফোরটিকেটি ডটকম, আদিয়ান মার্ট, গ্লিটার্স আরএসটি ওয়ার্ল্ড, গ্রিন বাংলা ই-কমার্স, অ্যানেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড, আমারবাজার এবং এক্সেলেন্ট ওয়ার্ল্ড এগ্রো ফুড অ্যান্ড কনজিউমার।

এ কোম্পানিগুলো ক্রেতাদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে অগ্রিম টাকা নিয়েছে। সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ক্রেডিট অথবা পণ্য কিনেছে, কিন্তু মূল্য পরিশোধ করার মতো পর্যাপ্ত টাকা নেই কোম্পানিগুলোর কাছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে মন্ত্রণালয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপুল সংখ্যক ক্রেতা ও সরবরাহকারী তাদের বকেয়া অর্থ পাবে না এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি প্রতারণামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। কারণ কিছু কোম্পানির মালিক ইতিমধ্যেই বিদেশে পালিয়েছেন।

ভবিষ্যতে কিছু কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয় প্রতিবেদনে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে ই-কমার্স খাতের বর্তমান সংকট নিয়ে আলোচনা হয়। এতে
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাসান মাহমুদ এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন। গ্রাহকদের বকেয়া পেমেন্ট পুনরুদ্ধারের জন্য আরও আলোচনার পরামর্শ দেয়া হয় ওই বৈঠকে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালকও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। যেসব কোম্পানির মালিক এখনও পালিয়ে যাননি তাদের উপর নজর রাখতে বলা হয়েছিল।

যারা ইতিমধ্যে পালিয়ে গেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয় ওই বৈঠকে।

বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ইভ্যালি এবং ই-অরেঞ্জ মালিকরা কারাগারে আছেন এবং ধামাকা’র সাথে জড়িতদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, আলেশা মার্ট এখনও কিছু প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, এবং আরও কয়েকটি কোম্পানি একইভাবে ব্যবসা করছে।

তিনি বলেন, এসব কোম্পানি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

ই-অরেঞ্জ অবৈধভাবে গ্রাহকদের প্রলুব্ধকর অফার দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইতিমধ্যেই এর কয়েকজন মালিককে আটক করেছে। মালিকদের একজন বনানী থানার ইন্সপেক্টর সোহেল রানা, যিনি প্রতিবেশী দেশে পালানোর সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে ধরা পড়েন।

ধামাকা শপিংয়ের প্রধান মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন চিশতী প্রতারণার মাধ্যমে ৫৮৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের অধিকাংশ সদস্যও দেশ ত্যাগ করেছেন। এখন অফিস বন্ধ থাকলেও চিশতি প্রতি সপ্তাহে ফেসবুক লাইভে গ্রাহকদের বিভিন্ন উপায়ে আশ্বস্ত করছেন।

ধামাকা শপিং সোমবার একটি ইমেইলে দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেছে, ই-কমার্স সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রশাসনিক এবং অবকাঠামোগত বাধা দূর করার জন্য সরকারের অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ সেক্টরে কিছু সমস্যা ছিল। ব্যাপক সমস্যা এবং অস্পষ্টতা রয়েছে, বিশেষত ধামাকা কেনাকাটা নিয়ে। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান সংকট মোকাবেলার ভবিষ্যত পরিকল্পনা উপস্থাপন করার কথা ছিল ২৮ সেপ্টেম্বর।

কিন্তু ঠিক এর আগের দিন সোমবার রাতে আরেকটি ইমেইলে কোম্পানিটি বলেছে, অনিবার্য পরিস্থিতির কারণে সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে, এবং নতুন সময়সূচি পরবর্তীতে জানানো হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেল সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানিসহ ৯টি কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ সংগ্রহ করার অনুরোধ জানিয়েছে। পরে আরও কোম্পানি সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হবে।

এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়কে এসব বিষয়ে নজরদারি জোরদার করতে বলা হয়েছে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ই-ক্যাব) এ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ই-কমার্সের অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার পর গত বছরের নভেম্বরে প্রতিযোগিতা কমিশন নিজ উদ্যোগে মামলা করেছিল।

ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা অধিদপ্তর তখন গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়। মহামারি চলাকালীন কোম্পানিগুলো দ্রুত ব্যবসা সম্প্রসারণ করলে কয়েক লাখ গ্রাহক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা হারায়।

তিনি আরও বলেন, এটি পুরো ই-কমার্স খাতকে প্রভাবিত করেছে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় মন্ত্রণালয় সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছে।

গ্রিন বাংলা ই-কমার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, তারা কখনো গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম পেমেন্ট নেয়নি বা লোভনীয় অফার দেয়নি।

তিনি বলেন, তার কোম্পানি ক্রেতাদের কাছে কোনো ঋণী নয়। করোনায় সৃষ্ট আর্থিক সংকটের কারণে তিনি গত বছরের নভেম্বরে কোম্পানিটি বন্ধ করে দেন।

সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য সহযোগিতা চেয়ে ই-ক্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করার সময় তিনি আশ্বাস পেয়েছিলেন। তিনি জানেন না, কেন মন্ত্রণালয় মনে করে তার বন্ধ থাকা কোম্পানিও ঝুঁকিতে রয়েছে।

অ্যানেক্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রশাসন প্রধান জুনায়েদ হাসান বলেন, কোম্পানির গ্রাহকদের কোন ঋণ নেই এবং তারা এখন নগদ লেনদেন করছে।

তিনি বলেন, কোম্পানি অফারসহ পণ্য বিক্রি করে না, এবং তাই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা উচিত নয়।

কিন্তু ই-ক্যাব আমাদের ওয়েবসাইট আপডেট করতে বলেছে, এবং আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের কোনো সমস্যার কথা জানায়নি।

আমারবাজারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, তার কোম্পানি ক্রেতা বা সরবরাহকারীদের কাছে কোনো ঋণী নয়, এবং সমস্ত লেনদেন এখন নগদ ব্যবহার করে করা হয়।

তিনি বলেন, আমরা সব পেন্ডিং প্রোডাক্ট সরবরাহ করেছি এবং এখন কোন ক্রেতা অভিযোগ করতে পারবে না।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গ্রাহকদের প্রতারণার অভিযোগে কয়েক ডজন ই-কমার্স কোম্পানিকে জরিপ করছে। তারা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছে।

এ সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকদের প্রতারণা করে আসছে। বিশেষত কোভিড-১৯ মহামারির সময়। আকর্ষণীয় অফার দ্বারা প্রলুব্ধ লাখ লাখ গ্রাহক বিপুল পরিমাণ অর্থ হারিয়েছেন।

এসব গ্রাহককে নকল পণ্য দেয়া হয়েছে, এমনকি অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পরও পণ্য তারা পাননি।