প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

ঊর্ধ্বমুখী স্টেশনারির বাজার

৩০ অক্টোবর ২০২১ ১৫:২২:০৭ | আপডেট: ৩ years আগে
ঊর্ধ্বমুখী স্টেশনারির বাজার

আব্দুর রাজ্জাক সোহেল

দিন দিন বেড়েই চলেছে একাডেমিক ও অফিস স্টেশনারি সামগ্রির চাহিদা। এতে দেশীয় স্টেশনারি শিল্প ধীরে ধীরে পৌঁছাচ্ছে নতুন উচ্চতায়।

শিল্পটি মূলত একাডেমিক ও কর্পোরেট এ দু’টি সেক্টরের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। যখন স্টেশনারি পণ্যের ব্যবহারের বিষয়টি ভাগ করার কথা আসে, তখন দেখা যায় এটির বাজারের সিংহভাগই স্কুল স্টেশনারির, এর একটি অংশ অবশ্য রয়েছে কর্পোরেট সেক্টরের দখলেও।

সূত্র বলছে, দেশীয় উৎপাদকরা প্রায় ৫০০টি বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে এবং বর্তমানে এটি আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে, স্টেশনারি ব্যবসা বছরে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রায় ৩৫ শতাংশ দেশীয় চাহিদা মেটানো হয় দেশে উৎপাদিত এসব সামগ্রির মাধ্যমে, বাকিটা পূরণ করে আমদানি পণ্য।

মাত্র এক দশক আগেও বাংলাদেশ সীমিত আকারে শিক্ষার্থীদের জন্য শুধুমাত্র কলম এবং নোট বই তৈরি করত, এখন এটি রফতানিতে পরিনত হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৫ হাজার ১৪ মার্কিন ডলার মূল্যের বল পেন রপ্তানি হয়েছে।

বিদেশি বাজারের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, আজারবাইজান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব।

দেশীয় স্টেশনারি উৎপদকরা বলছেন, তারা তাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিদের তুলনায় কম দামে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করছেন এবং এইভাবে বিদেশি পণ্যের হাত থেকে দেশীয় বাজার দখলের চেষ্টা করছেন।

বর্তমানে চীন, ভারত, জার্মানি, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ থেকে আমদানি করা হয় এসব সামগ্রী।

এ ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা অনুমান করেছেন, বর্তমানের স্টেশনারির বাজারের আকার ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে দেশীয় পণ্যের মূল্য ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্র্যান্ডের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

দেশে তৈরি স্টেশনারি আইটেমগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যায়ামের বই, নোট বই, কলম, পেন্সিল, স্কেল, ডাস্টার, ইরেজার, শার্পনার, পেন্সিল বক্স, জ্যামিতি বক্স, রুলার, রঙ পেন্সিল, মার্কার, রেহাল এবং একাডেমিক ফাইল, কাটার, বাইন্ডার ক্লিপ, স্ট্যাপলার, আইডি কার্ডধারক, কাঁচি, বাসি পিন, স্পঞ্জ ড্যাম্পার, স্ট্যাম্প প্যাড, স্ট্যাপল রিমুভার, ট্যাপ ডিসপেনসার, পাঞ্চ, ভিজিটিং কার্ডধারক এবং ডেস্ক অর্গানাইজার।

স্টেশনারির বাজারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ম্যাটাডর স্টেশনারি, ম্যাটাডোর গ্রুপ, গুড লাক স্টেশনারি, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, ফ্রেশ স্টেশনারি, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম স্টেশনারি। সারা বছর চাহিদা স্থিতিশীল থাকায় অনেকেই এ খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।

ম্যাটাডর গ্রুপের উপ-মহাব্যবস্থাপক তানভীর আহমেদ বলেন, তারা দেশীয় ও বৈশ্বিক উভয় বাজারের জন্য ১২৮টি আইটেম সরবরাহ করছেন।

এ শীর্ষ নির্বাহী জানান, একটি তৃতীয় পক্ষের সহায়তায় আমাদের রপ্তানি গন্তব্য এখন দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, আজারবাইজান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি।

কোম্পানিটি স্থানীয় বাজারে বার্ষিক ৩০০ কোটি টাকা থেকে ৩২০ কোটি টাকা মূল্যের স্টেশনারি আইটেমের বেশিরভাগ কলম, পেন্সিল, ফাইল, স্কেল, ইরেজার বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে প্রায় ৮.৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে।

এস আলম স্টেশনারির বিপণন ব্যবস্থাপক মো: নাহিদ হোসেন জানান, তারা তাদের আমদানি করা একই রকম পণ্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উদ্ভাবনসহ একাধিক ধরনের পণ্য উৎপাদন করছেন।

তিনি বলেন, এখন আমাদের দেশীয় বাজারে ৫০ ধরনের পেন্সিল বক্স এবং ২০ ধরনের স্কেল রয়েছে। শুধুমাত্র পেন্সিল বাক্স এবং স্কেল থেকে আমাদের ৭০ কোটি টাকা বার্ষিক টার্নওভার আছে। ব্যায়ামের বই, কলম, পেন্সিল বক্স, স্কেল এবং ফাইল বিক্রিতে দেশীয় উৎপাদনকারীদের আধিপত্য রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দেশীয় পণ্যে‘মেড ইন চায়না’লাগিয়ে বাজারে বিক্রি করছে।

দেশে তৈরি ব্যায়াম বই, কলম, ফাইল এবং স্কেল দেশীয় চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিলে আমদানিনির্ভরতা অনেকাংশে কমে যাবে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

দেশীয় উৎপাদকদের সামনে চ্যালেঞ্জ

দেশীয় কোম্পানিগুলো হাতেগোনা কিছু স্টেশনারি আইটেম তৈরি করছে, অথচ দেশের বাজারে প্রায় ১০ হাজার রকম আইটেম পাওয়া যাচ্ছে।

আমদানিকারকদের দাবি, দেশীয় পণ্যের চেয়ে বিদেশ থেকে আনা পণ্যের গুণগত মান ভালো, সেইসাথে শুল্ক পরিশোধ করার পরও দাম কম থাকে।

চক মোগলটুলির এক আমদানিকারক মর্তুজা স্টেশনারির সত্বাধিকারী মোহাম্মদ জমির উদ্দিন বলেন, প্রায় ১০০ আমদানিকারক প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার স্কুল ও অফিসের স্টেশনারি আইটেম চীন থেকে নিয়ে আসে।

তিনি যোগ করেন, দেশীয় পণ্যের তুলনায়, আমদানিকৃত পণ্যের মান ভালো। তাই মানুষ দেশীয়পণ্যের চেয়ে আমদানি করা পণ্য পছন্দ করে বেশি।

তার পরামর্শ, বিশ্ব বাজারের সাথে তাল মেলাতে আমাদের গুণগত মান এবং পণ্যের বৈচিত্র্য উন্নত করতে হবে।

মেসার্স রহমান অ্যান্ড ব্রাদার্স-এর ব্যবস্থাপক মো: রমজান আলীর মতে, দেশীয় উৎপাদকদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য স্টেশনারি আইটেমগুলোতে বৈচিত্র্য আনতে হবে, পাশাপাশি তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আইটেমগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর ব্যবসা ভালো

করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্টেশনারি ব্যবসায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু হওয়ার পর ব্যবসাটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কয়েক বছর সময় লাগবে।

নিউমার্কেটের মডার্ন স্টেশনারির কো-অর্ডিনেটর আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, তারা মাসে ৫ লাখ টাকা বিক্রি করতেন, যা মহামারির কারণে ৮০ শতাংশই কমে গেছে।

তিনি বলেন, স্কুল পুনরায় খোলার পরে ব্যবসাটি আবারও সচল হতে শুরু করে, তবে নিয়মিত ক্লাস পুরোদমে চালু না হওয়ায় তা পুরোপুরি ঘুড়ে দাঁড়াতে পারছে না।

কর্পোরেট সেক্টরের স্থিতিশীলতায় চাহিদা

স্টেশনারির বাজারের বৃদ্ধিতে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে কর্পোরেট সেক্টর। কারণ, ব্যবসা কমবেশি চলছেই।

ব্যবসায়ীরা জানান, স্টেশনারি ব্যবসায় বার্ষিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে; কর্পোরেট সেক্টর যেমন বাড়ছে, তেমনি স্টেশনারি পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে।

পুনরায় সব সচল হওয়ায় বেড়েছে দাম

করোনা মহামারি আগের তুলনায় এখন স্টেশনারি পণ্যের দাম বেড়েছে। আর এজন্য আন্তর্জাতিক বাজারে ১৫-২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন আমদানিকারকরা। যার প্রভাব পড়েছে দেশীয় বাজারে।

মর্তুজা স্টেশনারীর কর্মী মো: রুবেল বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে আমাদের বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।

কেউ কেউ অভিযোগ করেন, দেশের ব্যবসায়ীরা খুব বেশি আমদানি নির্ভর হওয়ায় কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে।