প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

কমেছে অর্ডার, সঙ্কটে তৈরি পোশাক খাত

আরিফুর রহমান তুহিন
০৩ জুলাই ২০২২ ১২:১৬:১২ | আপডেট: ৩ years আগে
কমেছে অর্ডার, সঙ্কটে তৈরি পোশাক খাত

আতিকুর রহমান। ‍যিনি গত বছরের শুরুর দিকে গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানা চালু করেছিলেন। ওই সময় কাজের বিপুল অর্ডার পাওয়া গেলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তার ব্যবসা এখন হুমকির মুখে।

দ্য বিজনেস পোস্ট‘কে আতিকুর বলেন, “সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ক্রেতারা ধীরে ধীরে কাজের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন।”

তিনি জানান, গত জুনের শেষ ২০ দিনে, তিনি একটি পোশাকও তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু শ্রমিকদের ২০ লাখ টাকা মজুরি ঠিকই তাকে পরিশোধ করতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি কারখানা বিক্রির পরিকল্পনা করেছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো ক্রেতাই মেলেনি।

আতিকুরের মতো ৮৮টি কারখানার মালিক কার্যাদেশের অভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেননি। ১০০টিরও বেশি কারখানা শুধুমাত্র ন্যূনতম কার্যাদেশ নিয়ে কোনোমতে চালু হয়েছে, যার ফলে প্রচুর লোকসান হয়েছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

বর্তমানে চালু থাকা তৈরি পোশাক কারখানার অধিকাংশই তাদের সক্ষমতার ৭০ শতাংশে চলছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) কার্যনির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, পরিস্থিতি এমন যে, বেঁচে থাকাই এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, “অনেক ছোট কারখানার মালিক প্রতিদিন আমাকে কিছু অর্ডার দেওয়ার জন্য ফোন করেন, কিন্তু আমি বেশিরভাগ সময় তাদের সাহায্য করতে করতে পারি না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পরবর্তীতে কী ঘটবে তা আমি জানি না।”

ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, এখন তিন-চারজন ক্রেতার ওপর নির্ভর করে টিকে থাকা কঠিন।

তিনি আরও বলেন, “যদি সাব-কন্ট্রাক্টটররা সরাসরি আদেশ না পায় এবং কারখানা চালু রাখে তাহলে তারা আগামী দিনে আরও সমস্যায় পড়বে।”

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, পোশাক রপ্তানি আয় এপ্রিলে ৩.৯৩ বিলিয়ন ডলার থেকে মে মাসে ৩.১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি যুদ্ধের কারণে ঘটেছে এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, পোশাক রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০ শতাংশে নেমে আসতে পারে যা এখন ৩৫ শতাংশের উপরে৷

শিল্প সংশ্লিষ্ট ও শিল্প পুলিশ কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, তারা অন্তত ৮৮টি কারখানার খোঁজ পেয়েছেন, যারা জুনের মজুরি দিতে পারছে না। আর্থিক সঙ্কটের কারণে বেশিরভাগ কারখানাই মে মাসের মজুরি পরিশোধ করতে পারেনি।

শুধু এ ৮৮টি নয়, সব সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাও অর্ডার সঙ্কটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঈদুল আজহার পর বর্তমান সঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে তারাও তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে।

এমনকি অনেক স্বনামধন্য কারখানাও আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি। তবে ব্যাংকগুলো তাদের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে, যা তাদের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে।

চীনের বিদ্যুতের ঘাটতি, পশ্চিমাদের সঙ্গে এর বাণিজ্য বিরোধ, মিয়ানমারের রাজনৈতিক সঙ্কট এবং ভিয়েতনামের কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে ক্রমবর্ধমান কাজের আদেশের কারণে গত বছরের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানা বেড়েছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) দাবি, দুই মাস আগে প্রায় ১ হাজার ১০০টি সাব-কন্ট্রাক্ট পোশাক কারখানা চালু ছিল, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক এবং প্রায় ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।

বিজিএমইএর ভাইস-প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, প্রায় ৫ বিলিয়ন মূল্যের পোশাক সামগ্রী সাবকন্ট্রাক্টিং কারখানা থেকে পাওয়া যায়।

কিন্তু কার্যাদেশের স্বল্পতার কারণে শতাধিক সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা আরও বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বর্তমান ওয়ার্ক অর্ডার সংকটের প্রধান কারণ।

বাংলাদেশের পোশাক খাত গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাশিয়া থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে এবং আরও প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার পরোক্ষভাবে এসেছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়ায় রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

অন্যদিকে, যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ক্রেতারাও অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন।

ফ্যাব্রিকা নিট কম্পোজিট সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোতে অর্ডার সরবরাহ করছে এবং এর অন্যতম প্রধান ক্রেতা রাশিয়ান।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন,
“আমি বার্ষিক প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক পণ্য সরাসরি রাশিয়ায় রপ্তানি করতাম, কিন্তু এখন পেমেন্ট সমস্যার কারণে আমি তাদের কাছ থেকে কোনো অর্ডার পাচ্ছি না। এই কারণেই আমি সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলিতে পর্যাপ্ত অর্ডার দিতে পারি না।”

নিপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ খসরু চৌধুরী দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, তিনি সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোকে ওয়ার্ক অর্ডার দিচ্ছেন, কিন্তু অর্ডার সঙ্কটের কারণে পরিমাণ কমাতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, “অনেক কারখানার মালিক আমাকে জানিয়েছেন, তাদের কাছে একটি অর্ডারও নেই। যুদ্ধ বন্ধ না হলে বেশিরভাগ সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানা সেপ্টেম্বরের পরে টিকে থাকতে পারবে না।”

শুধু সাব-কন্টাক্ট কারখানাই নয়, অনেক নামকরা কারখানার মালিকও তার কাছে অর্ডার নিতে আসেন বলেও জানান খসরু।

সূত্র জানায়, গত ২৯ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি সভা করেছে। বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় ১০০টি কারখানা জুন মাসের মজুরি দিতে ব্যর্থ হবে, ঈদুল আজহার উৎসব বোনাস এসব প্রতিষ্ঠানে অনিশ্চিত।

বৈঠকে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ অংশগ্রহণকারীরা জানান, ৮৮টি কারখানা তাদের সদস্য নয়, কিন্তু অর্ডার সঙ্কটের কারণে তাদের সদস্যরাও সঙ্কটে পড়েছে।

ওই ৮৮টি কারখানার জন্য কিছু করার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েন সংগঠনগুলোর নেতারা।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, “বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যদি মালিকরা কারখানা বিক্রি করতে বাধ্য হয়, তাহলে তাদের বকেয়া মজুরি দেয়ার জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা জানি, তাদের সম্পদ বিক্রি করা ছাড়া তাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই।”