মেহেদী হাসান
বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে সরকারি ব্যাংক খাতে।
রাষ্ট্র পরিচালিত অগ্রণী ব্যাংক এরই মধ্যে খেলাপি শিল্প প্রতিষ্ঠান তানাকা গ্রুপকে নীতি বহির্ভুত সুবিধা দিতে ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো’র (সিআইবি) প্রতিবেদনে ঋণের তথ্য গোপন করেছে। সেই সাথে এলসি খোলারও অনুমোদন দেয়।
ঘটনাটি ২০২০ সালে ঘটলেও, অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের ৬৭৮তম সভায় ব্যাংকটির ওই ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি উঠে আসে।
গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে ব্যাংকটির কাছে ব্যাখ্যা তলব করে চিঠি পাঠায়। ৭ দিনের মধ্যে এর জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রেরিত চিঠিতে বলা হয়, তানাকা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সুইস কোয়ালিটি পেপার (বিডি) লিমিটেডের অনুকূলে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১৩.৬৪ কোটি টাকার একটি এলসি অনুমোদন দেয় অগ্রণী ব্যাংক।
পরবর্তীতে ওই বছরেরই অক্টোবরে একই ব্যবসায় আরো ১২.৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে এলসি সুবিধা দেওয়া হয়, ততক্ষণে অন্য দুটি ব্যাংকের কাছেও ঋণ খেলাপি হয় শিল্প গ্রুপটি।
ঠিক যে সময়ে অগ্রণী ব্যাংক সুইস কোয়ালিটি পেপার (বিডি) লিমিটেডকে এলসি সুবিধা দেয়, তখন ওই গ্রুপটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০৩.৬৫ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।
প্রতিবেদনে জানা যায়, মাইটাস স্পিনিং মিলস লিমিটেড নামের তানাকা গ্রুপের অপর একটি প্রতিষ্ঠানেরও ৫৪.২৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছের রাষ্ট্র পরিচালিত সোনালী ব্যাংকের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে এলসি সুবিধা দেয় অগ্রণী ব্যাংক।
অগ্রণী ব্যাংকের এমন কর্মকাণ্ড ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ধারাবাহিক লঙ্ঘন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, ওই আইনের ২৭ ধারা অনুসারে কোনো খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে পারে না কোনো ব্যাংক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, গ্রুপটির ঋণের অবস্থা বিবেচনা না করেই শিল্প গ্রুপকে ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যাও সন্তোষজনক নয়।
তিনি জানান, ধারা ২৭ লঙ্ঘনের কারণে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারা ১০৯ এর উপ-ধারা ১১ এর অধীনে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তিনি ইঙ্গিত করেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারা লঙ্ঘনের কারণে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মারহাবা স্পিনিং মিলস লিমিটেড নামে তানাকা গ্রুপের অপর একটি প্রতিষ্ঠানেরও অগ্রণী ব্যাংকে ২০৮ কোটি টাকার বেশি শ্রেণীভুক্ত ঋণ রয়েছে।
ব্যাংকটি ঋণ পুনঃতফসিল র্নির্ধারণ করেছিল গত বছরের জানুয়ারিতে, কিন্তু তা সিআইবি রিপোর্টে উল্লেখ করেনি। বর্তমানে ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে ২৬৯.৮ কোটি টাকা।
এ তথ্য গোপন করাকেও বিধির লঙ্ঘন বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠিতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম।
তিনি বলেন, আগে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা ভালো না থাকলেও এখন ভালোভাবেই ব্যবসা পরিচালনা করছে। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে এলসি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী বলেন, গ্রুপের খেলাপি ঋণ পরে পুনঃতফসিল করা হয়েছে। আমি শুনেছি, সোনালী ব্যাংকের সাথে গ্রুপটির খেলাপি ঋণও পুনঃতফসিল হয়েছে।
সিআইবি রিপোর্টে ঋণের অবস্থা গোপনের বিষয়টি ইচ্ছাকৃত নয় বলে দাবি করেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম।
তিনি বলেন, এলসি খোলার পদ্ধতি ম্যানুয়াল হওয়ায় এমনটি হয়েছে। তবে ওই ব্যবস্থাপনা আরও উন্নতকরণে কাজ চলছ।
২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তানাকা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ৫৪৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এসব ঋণ দেয়ায় ২০১৬ সালে নানা অনিয়মের প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ওই সময় তানাকা ট্রেডকম নামে তানাকা গ্রুপের অপর একটি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার অনিয়মের অভিযোগে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আব্দুল হামিদকে সরিয়ে দেয় ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা যায়, তানাকা গ্রুপের মালিক মহিউদ্দিন মাহিনের ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুরে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সুইস কোয়ালিটি পেপার (বিডি) লিমিটেড, মাহিন এ্যাপারেল্স, মারহাবা স্পিনিং মিলস লিমিটেড, তানাকা ট্রেডকম লিমিটেড, তানাকা পেট্রোল পাম্প এবং তানাকা শপিং কমপ্লেক্স অন্যতম।
২০২০ সালের জুন পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের কাছে তানাকা গ্রুপের ৬টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৬৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবসায় ক্ষতির কারণে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গ্রুপটির আমদানি, রপ্তানিসহ সব ধরনের ব্যবসা বন্ধ থাকায় ঋণ পরিশোধ এখন অনিয়মিত।
তানাকা গ্রুপের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন মাহিনের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলতে দ্য বিজনেস পোস্টে'র প্রতিবেদক একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।