মিরাজ শামস
গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম দারাজ একটি প্রচারাভিযান চালিয়েছে। আর এটি নিয়েই এখন মতভেদ চলছে সরকারের সাথে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গত ১১ নভেম্বরের একটি কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে দারাজ দাবি করেছে, তারা ১ নভেম্বর থেকে ১১.১১ প্রচারণা চালানোর সময় কোনো আইনের লঙ্ঘন করেনি।
কিন্তু মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কোম্পানিটি স্পষ্টভাবে আইন লঙ্ঘন করেছে। প্রচারণার জন্য কেন কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে না তারও ব্যাখ্যা চেয়েছে মন্ত্রণালয়।
দারাজের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এএইচএম হাসিনুল কুদ্দুস (রুশো) জবাবে বলেন, কোম্পানি ডিজিটাল কমার্স ম্যানেজমেন্ট নির্দেশিকা, প্রতিযোগিতা আইন, ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা আইন এবং চুক্তি আইন লঙ্ঘন করেনি।
তিনি বলেন, অভিযানে কোনো জুয়া বা লটারিও নেই।
এছাড়াও তিনি বলেন, ক্যাম্পেইনের অধীনে ১ টাকার গেমটি একটি বিনামূল্যের অংশগ্রহণমূলক কুইজ প্রতিযোগিতা, যা মূলত একটি দক্ষতা-ভিত্তিক খেলা; যেখানে সঠিক উত্তরটি যিনি আগে জমা দেন, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তাকেই বিজয়ী নির্বাচন করা হয়।
এ কারণে ১ টাকার খেলা লটারির আওতায় পড়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, দারাজ ৭ নভেম্বর প্রচারণার সপ্তম দিন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোনো পর্যবেক্ষণ বা আপত্তি পায়নি। তখন পর্যন্ত, কোম্পানি সমস্ত প্রচারমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এবং সংশ্লিষ্ট খরচও বহন করেছে।
রুশো বলেন, মন্ত্রণালয়ের কোনো আপত্তি বা নিষেধাজ্ঞার অনুপস্থিতির কারণে দারাজ উল্লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতাটি পরিচালনা করার জন্য একটি বৈধতা প্রত্যাশা করেছির। যদিও, বৈধতা অর্জন সত্ত্বেও পরবর্তীতে দারাজ ১১ নভেম্বর প্রতিযোগিতাটি বন্ধ করে দেয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নোটিশে দারাজকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়, কিন্তু দারাজ ১৮ নভেম্বর জবাব দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, দারাজ সর্বদা আইন ও বিধি-বিধানকে সম্মান করে এবং প্রচারণার কোনো যোগাযোগ বা প্রচারের আগে ১ টাকার খেলা চালানোর বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যথাযথভাবে জানিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেছেন, দারাজ আইন লঙ্ঘন করেছে। কারণ, প্রতিষ্ঠানটি ৬ অক্টোবর প্রচারণা চালানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়েছিল।
তিনি বলেন, কিন্তু অনুমতি না নিয়েই তারা প্রচার চালিয়েছে।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় ৪ নভেম্বর একটি নোটিশে দারাজকে প্রচারণা না চলানোর নির্দেশ দেয়। ওই নোটিশে ১ টাকার গেম এবং স্পিন দ্য হুইল-এর মতো অফার রয়েছে।
কিন্তু তার পরও প্রতিষ্ঠানটি প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, সে কারণেই মন্ত্রণালয় ১১ নভেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। এর জবাবে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তারা গত বছর প্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু ডিজিটাল কমার্স ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয় চলতি বছরের ৪ জুলাই।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, নির্দেশিকাগুলো বলে, ই-কমার্স সংস্থাগুলো সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া র্যাফেল ড্র বা লটারির ব্যবস্থা করতে পারে না। যদি কোনো কোম্পানি এটি মেনে না চলে, তাহলে পেনাল কোড ১৮৬০ এর ধারা ২৯৪ (বি) এর জন্য প্রযোজ্য হবে।
দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ২৯৪ (বি) বলে, এ ধরনের কাজগুলোর দায়ে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হতে পারে।
নির্দেশিকাগুলো লটারিকে, কোনও টিকিট বা নম্বরের ভিত্তিতে এলোমেলোভাবে বিজয়ীদের নির্বাচন করার এবং তাদের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করার প্রক্রিয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে।
এদিকে, দারাজের কার্যক্রম তদন্ত করছে প্রতিযোগিতা কমিশন। বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, দারাজের প্রচারণা, প্রতিযোগিতার নিয়ম বহির্ভূত হতে পারে। আমরা তদন্তের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
কোম্পানি ও বাণিজ্যিক আইনে বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহসানুল করিম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ব্যবসায়িক আইন আছে, কিন্তু অনেক কোম্পানি সেগুলো মানে না।
তিনি বলেন, দারাজ প্রচারণা চালিয়ে আইন লঙ্ঘন করেছে। সরকার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, দারাজ কীভাবে পণ্য আমদানি করে এবং অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা করে তা সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত। তিনি বলেন, তাদের পণ্য আমদানিতে কর বা শুল্ক ফাঁকির সম্ভাবনাগুলোও তদন্ত করা উচিত।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নোটিশের জবাবে দারাজ বলেছে, ২০১৮ সাল থেকে তারা প্রতি বছর ১১.১১ ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে, যে বছর প্রতিষ্ঠানটি আলিবাবার সঙ্গে শপিং ইভেন্টের একটি অংশ হয়, চীন ভিত্তিক কোম্পানিটি বিশ্বের সমগ্র ইকোসিস্টেমের মধ্যে সিঙ্গলস ডে উদযাপন করে।
কোম্পানিটি বলছে, বাংলাদেশে, ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির প্রয়াসে গ্রাহকদের একটি অনন্য ডিজিটাল কেনাকাটার অভিজ্ঞতা দিতে ১ টাকার গেমসহ বিভিন্ন গেমিং প্রতিযোগিতা পরিচালনার মাধ্যমে ১১.১১ উদযাপন করা হয়।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে, তারা ১৯ অক্টোবর প্রাপ্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরে এ বছর স্পিন দ্য হুইল প্রতিযোগিতা পরিচালনা করেনি।
তাছাড়া, ১ টাকার গেমের জন্য পদ্ধতিটি ছিল, অংশগ্রহণকারীরা একটি আকর্ষণীয় কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে, একটি নামমাত্র অংশগ্রহণ ফি ১ টাকা দিয়ে। যা দারাজ ক্যাম্পেইন শেষ হওয়ার পর ফেরত দেবে।
দারাজ বলেছে, ইতোমধ্যেই অর্থপ্রদান অংশীদারদের নির্দেশ দিয়েছে দারাজ, অংশগ্রহণকারীদের ১ টাকা ফেরত দিতেও শুরু করেছে।
৩ নভেম্বর, ই-ক্যাবের উপস্থিতিতে মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি বৈঠকে কোনও বিভ্রান্তি এড়াতে মন্ত্রণালয় দারাজকে অংশগ্রহণকারীদের থেকে নিবন্ধন ফি হিসেবে ১ টাকা না নেয়ার পরামর্শ দেয়।
কোম্পানিটি উত্তরে বলেছে, এ নির্দেশনা মেনে চলার জন্য তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে এবং ৩ নভেম্বর থেকে গেমটিতে বিনামূল্যে অংশগ্রহণ ঘোষণা করে।
দারাজ 8 নভেম্বর মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে গেমের পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে।
এছাড়া, প্রাসঙ্গিক আইনগুলোর নির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিক বিধানগুলো দিতেও মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে দারাজ, যা পরবর্তীতে এসব বিষয়ে পুনঃমূল্যায়ন এবং প্রয়োজনে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হবে।