মেহেদী আল আমিন
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ঘর সাজানোর রঙের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোতে সীসার স্তর অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
সীসা একটি বিষাক্ত ধাতু, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ- উভয়ের ওপরই বিরূপ প্রভাব ফেলে। সীসার বিষক্রিয়া সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের জন্য। এমন কী একজন গর্ভবতী নারীও তার শরীরে জমে থাকা সীসা গর্ভের বিকাশমান সন্তান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেন।
এটি বুকের দুধের মাধ্যমেও স্থানান্তরিত হয়। শৈশবকালে সীসার সংস্পর্শে আসার কারণে বুদ্ধিমত্তা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে কারণে ‘সীসা মানসিক প্রতিবন্ধকতার কারণ’ এমনটা উল্লেখ করে এটিকে স্বীকৃত রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) কর্তৃক ইন্টারন্যাশনাল পলুট্যান্টস এলিমিনেশন নেটওয়ার্ক (আইপিইএন) এর সহযোগিতায় পরিচালিত ‘বাংলাদেশে বাড়িতে ব্যবহারের জন্য দ্রাবক ভিত্তিক রঙে সীসা’ শীর্ষক সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘর সাজানোর রঙের ৩২ শতাংশ ব্র্যান্ডেই অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা রয়েছে। গত ৪ নভেম্বর গবেষণাটি প্রকাশ করতে যাচ্ছে ইএসডিও।
ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত, ইএসডিও ঢাকার দোকান থেকে ৬৩টি দ্রাবক-ভিত্তিক রঙের কৌটা সংগ্রহ করে, যেগুলো বাড়ি রং করার কাজে ব্যবহারের জন্য বিক্রি করা হয়। রংগুলো ২১টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ২৬টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব রঙের শুষ্ক ওজনের ওপর ভিত্তি করে সীসার মাত্রা নির্ণয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বীকৃত পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
বাংলাদেশের একটি রঙের নমুনা, যেটির দখলে রয়েছে এ বাজারের ৭ শতাংশ- তাতে দেখা যায়, ১ লাখ ৯০ হাজার পিপিএম (পার্টস প্রতি মিলিয়ন) সীসা রয়েছে। যা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) দ্বারা নির্ধারিত স্তরের চেয়ে ২ হাজার ১১১ গুণ বেশি। ৯০ হাজার পিপিএম ধারণ করা অন্য একটি ব্র্যান্ডে দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ স্তরের সীসা সনাক্ত করা হয়েছিল। ২৬টি ব্র্যান্ডের মধ্যে অন্তত ৬টি ব্র্যান্ড (পেইন্ট ব্র্যান্ডের ২৩ শতাংশ) ১০ হাজার পিপিএমের বেশি সীসার ঘনত্বসহ অন্তত একটি রং বিক্রি করেছে।
ইএসডিও-এর সেক্রেটারি-জেনারেল শাহরিয়ার হোসেন দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, কিছু কোম্পানি বিএসটিআই কর্তৃক নির্ধারিত মান অনুযায়ী তাদের রঙের ব্র্যান্ডের জন্য বিএসটিআই থেকে লাইসেন্স পেয়েছে। তারা তাদের রঙের কৌটায় সীসা-মুক্ত লিখেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের রঙে উচ্চ মাত্রার সীসার ঘনত্ব পাওয়া গেছে। এমনকি, সীসা-মুক্ত লেখা দুটি ব্র্যান্ডও শীর্ষ ১০ সীসা ঘনত্বের মাত্রার তালিকায় রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, নির্দেশনা অমান্যকারীরা নিজেদের সংশোধন করবে। আমরা তাদের বাজারের সুনামের দিকটি বিবেচনা করে প্রতিবেদনে তাদের নাম প্রকাশ করিনি। যদিও, আমরা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিএসটিআই, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (সিএবি) নাম ও সিসা ঘনত্বের মাত্রা জানাবো।
তিনি বলেন, শীর্ষ দশের বেশিরভাগ ব্র্যান্ডই বাংলাদেশি কোম্পানির মধ্যে বাজারের শীর্ষস্থানীয়। বাংলাদেশের পেইন্ট শিল্পের আয়তন ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।
২০১৮ সালে ঘর সাজানোর রঙের জন্য সর্বোচ্চ সীসার ঘনত্বের মাত্রা ৯০ পিপিএম নির্ধারণ করে দেয় বিএসটিআই। এটি ভারত, ফিলিপাইন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও ঘর সাজানোর রঙে সীসার মাত্রার সর্বোচ্চ নির্ধারিত সীমা।
বেশি বিপজ্জনক হলুদ রং
এ সমীক্ষায় দেখা যায়, হলুদ রঙে প্রায়ই ১০ হাজার পিপিএম-এর বেশি মাত্রায় সীসার ঘনত্ব থাকে। আসলে, পরীক্ষার ফলাফলে পাওয়া ১০ হাজার পিপিএম-এর উপরে সীসার মাত্রা ধারণ করা ৬টি রঙের সবগুলোই ছিল হলুদ রঙের।
বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) সাধারণ সম্পাদক অরুণ মিত্র দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, আমরা আমাদের সকল সদস্যকে রঙে সীসাযুক্ত উপাদান ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছি। একইভাবে, আমরা সরকারকে পেইন্টে ব্যবহৃত সীসাযুক্ত উপাদানের আয়কর বাড়াতে বলেছি।
তিনি বলেন, ধুসর, কমলা এবং হলুদ রং- ঘর সাজানোর কাজে ব্যবহৃত এ তিনটি উপাদানেই সীসা থাকে। সরকার যদি সীসাযুক্ত পিগমেন্ট এবং ড্রায়ারের আমদানি শুল্ক বাড়ায় এবং কর কমিয়ে সীসামুক্ত পিগমেন্ট এবং ড্রায়ারকে উৎসাহিত করে, তবে এটি দেশে সীসাযুক্ত রঙের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের একটি ভাল উপায় হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বিএসটিআই তাদের সার্টিফিকেটের শর্ত লঙ্ঘনকারীদের কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। আর ক্রেতারা রঙের ক্যানে বিএসটিআই লেভেল দেখে সেসব রং কিনছেন।
বিএসটিআই’র উপ-পরিচালক জহুরা সিকদার বলেন, অনুমোদিত মাত্রা অতিক্রম করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জোহুরা দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, নির্ধারিত মান লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দিতে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ ব্যবহার করে বিএসটিআই। সনদ পাওয়া যে কেউই শর্ত লঙ্ঘন করলে এবং যার সার্টিফিকেট নেই, কিন্তু অনুমোদিত মাত্রা লঙ্ঘন করেছে, তাদেরও বিভিন্ন মাত্রার শাস্তি পেতে হবে। এ ব্যাপারে আইন অনুযায়ী পুলিশও ব্যবস্থা নিতে পারে বলে জানান তিনি।