মেহেদী হাসান
করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় স্থবিরতার পর ফের প্রাণ ফিরে এসেছে দেশের আবাসন খাতে। যে কারণে ব্যাংকগুলোতে বেড়েছে হোম লোনের চাহিদা।
করোনার সংক্রমণ রোধ ও জীবন বাঁচাতে গত বছরের মার্চ থেকে দফায় দফায় লাগাতার লকডাউন ঘোষণা করে সরকার, এতে একেবারেই কমে যায় অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি।
এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে হোম লোনের চাহিদা থাকলেও, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় আরও একটি ধাক্কা দেয়।
তবে, এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসায় চলতি বছরের শুরু
থেকেই পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। এখন চেষ্টা চলছে আগের অবস্থায় ফিরে আসার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বকেয়া গৃহ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭১৭.৫২ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৬ হাজার ৬২ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং খাতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গৃহঋণ বেড়েছে ১৪.০২ শতাংশ; যখন সামগ্রিক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৩৫ শতাংশ।
এক অংকের সুদ হার মহামারির মধ্যেও এ হোম লোনের চাহিদা বাড়িয়েছে। ব্যাংকাররা বলেছেন, বেশিরভাগ ব্যাংক এখন আবাসন খাতকে ৭.৫০ থেকে ৮ শতাংশ সুদে অর্থায়ন করছে।
ঢাকা ব্যাংক ৭.৯৯ থেকে ৯ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দিচ্ছে। ব্যাংকটি এক বছরে আবাসন খাতের জন্য ২৫০ কোটি থেকে ৩০০ কোটি টাকা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এমরানুল হক বলেন, চলতি বছরের মাঝামাঝি থেকে হোম লোন চাওয়া শুরু হয়েছে এবং চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির এ উন্নতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী মাসগুলোতে এটি আরও বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, আমরা কম সুদের হারে ঋণ প্রদানের জন্য ১৫টি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছি। ঢাকা ব্যাংক ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্যও ঋণ প্রদান করছে।
একইভাবে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকও ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে হোম লোন দিয়ে যাচ্ছে।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস-উল ইসলামের মতে, গৃহ ঋণের জন্য আবেদন কিছুটা বেড়েছে এবং আগামী দিনে এটি আরও বাড়বে।
গ্রাহকরা এখনও অপেক্ষা করছেন আর চলমান করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। নির্মাণ সামগ্রীর দাম এখন বেশি, দাম কমে গেলে গৃহ ঋণের চাহিদা বেড়ে যাবে বলেও মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের এমডি।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে হোম লোন দিয়ে থাকে। এ খাতে ব্যাংকটির বকেয়া ঋণ ১ হাজার কোটি টাকা এবং মোট বকেয়া ঋণ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান বলেন, গত কয়েক মাস থেকে হাউজিং ঋণের আবেদন বেড়েছে।
ব্যাংক ঋণের নিম্ন সুদের হার এবং রিয়েল এস্টেট সেক্টরের জন্য সরকারের নীতি শিথিলকরণ এ ধরনের ঋণের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পিছনে প্রধান কারণ।
শুধু ব্যাংক নয়, বেশ কিছু নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হোম লোন প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রণী অবস্থানে রয়েছে, কিন্তু ক্লায়েন্টরা তাদের সুদের হারের পার্থক্যের কারণে এ ধরনের ঋণের জন্য নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে ব্যাংকেরর প্রতি বেশি ঝুঁকছে।
এখন ব্যাংকগুলো গৃহঋণের জন্য সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদের নিয়ে থাকে, যখন নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে থাকে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন একটি সরকারি খাতের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা দেশে আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পাশাপাশি ঘর নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য অর্থায়ন করে।
কর্পোরেশনের ১১টি ঋণ সেবা রয়েছে এবং এর সর্বোচ্চ ঋণ সীমা ২ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ফাইন্যান্স কোম্পানি ৭ থেকে ৮ শতাংশ সুদে হাউজিং ঋণ দিয়ে থাকে।
সরকারি খাতের এ সংস্থাটি ২০২০-২১ অর্থবছরে আবাসন খাতের জন্য ৬১৯ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে। যার মধ্য থেকে ৫১৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণও করেছে।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, অনুমোদন ও বিতরণের পরিসংখ্যান আগের বছরের তুলনায় ১৬৪ কোটি টাকা এবং ৯২ কোটি টাকা বেশি।
যোগাযোগ করা হলে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, আমরা মহামারির মধ্যেও অর্থবছর ২১-এ আবাসন খাতে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছি।
তিনি বলেন, চাহিদা বাড়ছে বলে আমরা চলতি অর্থবছরে আরও ঋণ বিতরণ করব। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের সক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে।
বিরূপ প্রভাব
দেশের আবাসন খাত মহামারীর কারণে অন্যান্য সেক্টরেও ডোমিনো ইফেক্ট ফেলতে শুরু করেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লকডাউনের কারণে নির্মাণ শ্রমিক এবং অন্যান্য কর্মচারীরা বাড়ি ফিরে যাওয়ায় রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সদস্যদের প্রায় ৬ হাজার প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছিল। অনেক গ্রাহকও সময়মত তাদের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিল না।
রিহ্যাবের সভাপতি ও শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, আমরা মহামারির কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমাদের বেশিরভাগ গ্রহক তাদের মাসিক পেমেন্ট আটকে রেখেছিল, করোনার কঠিন পরিস্থিতির কারণে। মহামারির ফলে আমরা ২টি মেলার আয়োজন করতে পারিনি।
এ ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন নির্মাণ কাজ আবারও শুরু হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে খাতটি পুরোপুরি ঘুরে যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন রিহ্যাব সভাপতি।
তিনি বলেন, সরকার যদি জমির নিবন্ধন ফি কমানোর পাশাপাশি অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয় তবে আগামী দিনে তাদের ব্যবসা গতি পাবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে উৎসের জবাব না দিয়ে সম্পত্তি, জমি এবং অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের অনুমতি দেয় সরকার।
অন্যদিকে, ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৯ শতাংশের নিচে খুব কম সুদে গৃহঋণ দিচ্ছে। আবাসন খাত সংশিষ্টরা মনে করছেন, স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণও এ খাতের পুনরুজ্জীবনের জন্য বেশ সহায়ক হচ্ছে।