চিনি আমদানিতে একক গ্রাহকের ঋণসীমা তুলে দেয়ার আবদার জানিয়েছেন দেশের বড় ব্যবসায়ীরা। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে দেশের চিনি উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করেছে এফবিসিসিআই।
আসন্ন রোজায় আমদানি বাড়িয়ে চিনির মূল্য সহনীয় রাখতে ঋণসীমায় ছাড় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। মূলত চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণকারী বড় গ্রুপগুলোর চাপেই এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে এ ধরনের চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে রোজা শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে ঋণসীমায় এ ধরনের ছাড় চাওয়ায় সংগঠনটির চিঠির যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ এত অল্প সময়ে ঋণসীমা ছাড়ের সুবিধা নিয়ে দেশে চিনি আমদানি করা প্রায় অসম্ভব। আর রোজার আগে সেই আমদানি করা চিনি যদি বাজারে না-ই আসে, তাহলে দাম কম এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই। তা ছাড়া চিনি আমদানির জন্য একক গ্রাহকের সীমায় ছাড় দেয়ার মতো এত ঋণের প্রয়োজনও নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সুযোগ দেওয়া হলে চিনি আমদানিতে যত খুশি তত ঋণ নিতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। এর মাধ্যমে ব্যাংকের টাকায় চিনির মজুদ বাড়াতে পারবেন তারা। এতে প্রকৃতপক্ষে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর লাভবান হবেন।
দীর্ঘদিন ধরেই চিনির বাজারে অস্থিরতা চলছে। গত বছরের জুলাইয়ের পর চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। আসন্ন রোজাকে সামনে রেখে এই অস্থিরতা আরও বেড়েছে। চিনির বাজারে অস্থিরতা রোধে এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের বেশ কিছু সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ও বাকিতে চিনি আমদানির সুযোগ। আর এখন চিনি আমদানিতে যত খুশি তত ঋণ পেতে একক গ্রাহকের ঋণসীমাই তুলে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সাধারণত একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে একটি ব্যাংক তার মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ দিতে পারে। কোনো অবস্থায় এর বেশি ঋণ দিলে তা ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬ (খ) ধারার লঙ্ঘন হয়। আবার ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো বিষয় উল্লেখ থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজ থেকে সে বিষয়ে ছাড় দিতে পারে না।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখার লক্ষ্যে এ খাতে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য কাঁচামাল আমদানির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একক গ্রাহক ঋণসীমা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সেই একই ছাড় চাইল চিনি ব্যবসায়ীরাও।
এ বিষয়ে গত ৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। ওই চিঠিতে বলা হয়, আসন্ন রমজানে অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির মূল্য সহনশীল রাখার জন্য চিনি উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ঋণসীমায় সাধারণ সীমাবদ্ধতাসংক্রান্ত ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬-এর (খ) ধারা হতে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করা হলো।
চিঠির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো চিঠি পাঠানো হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে তা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি।
দেশে এখন প্রতি মাসে গড়ে পৌনে দুই লাখ টনের কমবেশি চিনির চাহিদা রয়েছে। তবে রমজান মাসে এই চাহিদা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর এই চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ নেয় ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোমেন লিমিটেড এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দেশে চিনি আমদানি, রিফাইনিং, বিপণনসহ দেশের চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
চিনির কৃত্রিম সংকট, সিন্ডিকেট বা দাম বৃদ্ধিসহ চিনি বিষয়ক যা কিছুই হোক, তাদের ইশারা ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব না।
যদিও মিলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডলার সংকটে আমদানি ঋণপত্র খুলতে না পারায় চিনি আমদানি হচ্ছে কম। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন অনেকাংশে কমে গেছে। তাতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে দাম বেড়ে গেছে। বর্তমানে প্রতিকেজি চিনি ১১৫-১২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, রোজার আগমুহূর্তে এ ধরনের ছাড় চাওয়ার বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক। হয়তো কোনো গ্রুপের চাপাচাপিতে এ ধরনের ছাড় চাওয়া হয়েছে। তা ছাড়া চিনি আমদানির জন্য কোনো গ্রুপের এত ঋণের প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না।