রিফাত ইসলাম
সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় তারকাদের দ্বারা চোখ বুজে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অনুমোদন সম্প্রতি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে আইন বিশেষজ্ঞ এবং শিল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, যারা ব্যবসায়িক সত্তাগুলোকে সমর্থন করছেন তাদের অবশ্যই পণ্য বা পরিষেবার বিশ্বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করতে হবে।
সম্প্রতি বিতর্কের সৃষ্টি হয় যখন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ই-অরেঞ্জের সকল দায় থেকে সরে আসেন। ই-অরেঞ্জের বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় মাশরাফিকে। তিনি সেখানে বলেন- অনলাইনে আমার আস্থা ই-অরেঞ্জে।
গ্রাহকদের দাবি, নতুন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটিতে তার কথায় আস্থা রেখে প্রতারিত হয়েছেন হাজারো ক্রেতা।
মাশরাফি বলেন, আমি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার না, তাই আমি দায়ী নই। আমি গ্রাহকদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে যখন অফার আসে তখন কোম্পানিটির ট্রেড লাইসেন্স ছিল।
কিন্তু ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী এক গ্রাহক ইকবাল হোসেন বলেন, আমি মাশরাফীর কথায় বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ আমি তার ভক্ত। ই-অরেঞ্জে আমার সাত লাখ টাকার পণ্যের অর্ডার আছে। যা অনিশ্চয়তার মুখে।
ই-অরেঞ্জের মতো আরও বেশ কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি তাদের ব্র্যান্ডের প্রচারের জন্য মিডিয়ার জনপ্রিয় ব্যক্তিদের সাথে চুক্তি করছে। এ তালিকায় রয়েছে আলিশা হোল্ডিংস লিমিটেডের আলিশা কার্ডের জন্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ইভ্যালির জন্য সংগীতশিল্পী এবং অভিনেতা তাহসান রহমান খানসহ আরও অনেকে।
আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, সুনির্দিষ্ট আইনের অভাবকে কাজে লাগিয়ে ভোক্তাদের আগ্রহ বাড়াতে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের খ্যাতি ব্যবহার করে ত্রুটিযুক্ত পণ্য বা পরিষেবা বিক্রয় সহজ করে তুলেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
তারা আরও জানান, ক্লাস এ্যাকশন বা ম্যাস টর্ট আইনের আওতায় কোনো একজন ভুক্তভোগী সকল ভুক্তভোগীর পক্ষে মামলা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে যদি তিনি ক্ষতিপূরণ লাভ করেন তাহলে অন্য সকাল ভুক্তভোগীও তা পাবেন।
মিথ্যা ও ভুলভাবে উপস্থাপিত তথ্য দিয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয় করার চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশের ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ প্রতারণার জন্য মামলাও দায়ের করা হতে পারে।
দ্য বিজনেস পোস্টে'র সঙ্গে আলাপকালে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, যদি একজন ভোক্তা, একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটি পণ্য বা পরিষেবা কিনে থাকেন, কিন্তু দাবিকৃত সুবিধা না পায় বা সেবার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সে আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করতে পারবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম আসলাম বলেন, আইনশাস্ত্রের দৃষ্টিতে মাশরাফিকে তার দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে ভোক্তাদের প্রতারিত করার জন্য দায়বদ্ধ করা খুবই যৌক্তিক এবং এটি টর্ট আইনের আওতায় স্ট্রিক লাইবেলিটির ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বলেন, এ ধরনের দুর্ভোগের জন্য দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় আদালতে মামলা দায়ের করা যেতে পারে।
তবে তাড়াতাড়ি সমাধান পেতে আইনজীবী আসলাম নিম্ন আদালতে মামলা করার পরিবর্তে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, ভোক্তাদের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব যে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে তারাও দায়বদ্ধ। এজন্য বাদীকে আদালতে উপস্থাপন করতে হবে যে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার ব্যর্থতার ফলে এ ক্ষতি বা ভোগান্তি হয়েছে।
বাংলাদেশের এনডোর্সমেন্ট সেক্টরের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, তাদের দায় কোম্পানি এবং তারকাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির উপর নির্ভর করে।
অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা সাহা মিম জানান, তার সাথে কোম্পানি যে অর্থ দিয়ে চুক্তি করে তার থেকে কোম্পানির ব্র্যান্ড মূল্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, যে সকল পণ্যের আমি প্রচার করে থাকি তাদের মধ্যে একটি সাধারন চুক্তি থাকে, একই ধরনের পণ্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি প্রচার করতে পারবো না। তবে পণ্যগুলো ব্যবহার করার বিষয়টি সম্পূর্ন নিজের উপর নির্ভর করে।
ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের ম্যানেজার বর্ষন কবির বলেন, একটি ব্র্যান্ডে সংযুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার আগে তাকে কোম্পানি সম্পর্কে বিস্তারিক জানাই। তবে ওই ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করা সম্পূর্ণ তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।
গ্রে অ্যাডভারটাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার এবং ক্রিয়েটিভ চিফ সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন বলেন, সাধারণত এন্ডোসারকে সংশ্লিষ্ট পণ্য বা সেবা গ্রহন করতে হয় এবং যখন তারা দাবি করে যে আমি এই পরিষেবাটি ব্যবহার করছি এবং আপনারও এটি ব্যবহার করা উচিত, তখন তাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারণ মানুষ তাদের প্রতি বিশ্বাস করে। তবে আইনি বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে উভয় কোম্পানি এবং অনুমোদনকারীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ধারাগুলোর উপর নির্ভর করবে।
শাওন আরও বলেন, আমরা একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা হিসেবে এ নৈতিক বাধ্যবাধকতা অনুভব করি এবং তারকাদের পণ্য অনুমোদনের প্রস্তাব দেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করি। আমরা সাধারনত উভয় পক্ষের সাথে যোগাযোগ এবং আলোচনা করি যাতে প্রজেক্টটি বাস্তবায়িত হয়।