জাতীয় চা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছোট চা বাগানগুলোর ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি শুধু তাদের নিজেদের জীবিকা-ই নয় দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতেও অবদান রাখছে। তাদের এই উদ্যোগের জন্য চা বোর্ডের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১১ সালে বাংলাদেশের ১ দশমিক ৪০ লাখ একর জমির মধ্যে প্রায় ৬ কোটি কেজি চা উৎপাদন করেছে ক্যাশ করপোরেশন। ২০২১ সালে সেটি বেড়ে ১ দশমিক ৬১ লাখ একর জমিতে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৯ কোটি সাড়ে ৬ লাখ কেজি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘যদি আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চা উৎপাদন হয়, তাহলে পরবর্তী বিপ্লব চা উৎপাদনের হবে।’
তিনি বলেন, একটা পরিপূর্ণ চা বাগানের জন্য অনেক বড় জায়গার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বড় জায়গায় বাগান পরিচর্যার ব্যয় বহন করা ছোট উদ্যোক্তাদের পক্ষে অনেকাংশেই সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে ছোট জায়গায় চা উৎপাদন করাটা অনেকটা সহজ এবং স্বল্প খরচে সম্ভব হয়। তাই ‘আমার মতে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদানের মূল কারণ হচ্ছে ছোট চা বাগান।’
‘দ্য বিজনেস পোস্ট’-এর এক প্রতিবেদক পঞ্চগড় এবং লালমনিরহাটসহ আরও অনেকগুলো ছোট চা বাগানের উৎপাদন প্রক্রিয়া সরেজমিনে দেখেন এবং এসব অঞ্চলের ছোট চা বাগানের মালিকরা জানান, তাদের যেসব জায়গা এককালীন ধান চাষ ছাড়া অন্য কোন কাজে আসে না; সেসব জায়গায় ছোট পরিসরে চায়ের উৎপাদন শুরু করেছে অনেকে। পরবর্তীতে তারা স্বল্প পুঁজিতে ধানের চেয়ে চা উৎপাদনে অধিক মুনাফা অর্জনে করতে পারছে। ফলে এখন থেকে চা উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ছে অনেকের।
চা বাগান মালিক জাহাঙ্গির হোসাইন বলেন, ধানের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং অধিক লাভজনক চা উৎপাদন। তাই আমি আমার কম উৎপাদনশীল জমিগুলোতে চায়ের চাষ শুরু করেছি।
পঞ্চগড়ের শরিফ উদ্দিন বলেন, তিনি এখনো তালিকাভুক্ত চা বাগানের মালিক হননি। কিন্তু ২০১৭ থেকে তার নিজস্ব ১৫ দশক জমিতে চা উৎপাদনের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, তার প্রতিবেশি ছোট একটা চা বাগান করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখান থেকে আয়ের উৎস তৈরী করেছেন। আমিও তার থেকে উৎসাহী হয়ে নিজের কিছু পরিত্যক্ত জমিতে চা উৎপাদনের কাজ শুরু করেছি। বর্তমানে আমার বার্ষিক আয় প্রায় ২০ হাজার টাকা।
উত্তরবঙ্গ ছাড়াও ফটিকছড়ি এবং বান্দরবানের পাহাড়ী অঞ্চলগুলোতেও পাইলট পদ্ধতিতে চা চাষ শুরু করেছে চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। সূত্র থেকে জানা যায়, বান্দরবানে তালিকাভুক্ত আট হাজার ৩৪২ জন এবং তালিকাভুক্ত ছাড়াও ছোট চা বাগান মালিক রয়েছে। যাদের আওতায় প্রায় ৩১ হাজার কার্মচারি কাজ করে।
যেভাবে ছোট চা বাগান করা যায়
মজুতদাররা বলেন, যখন একজন কৃষক ছোট চা বাগান করতে আগ্রহী হয়, তখন স্থানীয় চা বোর্ড কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে মাটির গুণগত মান পরীক্ষা করে নেয়। যদি নির্ধারিত জায়গা চা বাগানের জন্য উপযুক্ত হয়; তাহলে চা বোর্ড কতৃপক্ষ থেকে চাষের প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
ক্যামিলিয়া খোলা আকাশ স্কুল। এটি একটি উন্মুক্ত স্কুল; যেখানে চা চাষ সম্পর্কে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন চা বোর্ড চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, কীভাবে চা গাছের যত্ন নিতে হবে, কীভাবে চা পাতা সংরক্ষণ করতে হবে এবং কীভাবে বিভিন্ন জীবাণু থেকে গাছকে রক্ষা করতে হবে এই সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
প্রশিক্ষণ শেষে ওই বাগান মালিককে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং তার বাগানের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সহায়তা করা হয়। এছাড়াও স্থানীয় কতৃপক্ষের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তালিকাভুক্ত মালিকদের বাগান পরিদর্শন করেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।
বাগান তৈরীতে আয়-ব্যয়
তালিকাভুক্ত হওয়ার পরে, বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী আগ্রহী মালিকের বাগান পরিচার্যা করতে হবে। তারপর চা গাছের গুণমানের উপর ভিত্তি করে দুই থেকে দশ টাকা পর্যন্ত মূল্য দিয়ে গাছ কিনতে হবে। তবে, ছোট বাগান মালিক বা নিম্ন শ্রেণির উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু কিছু সময় সরকার বিনামূল্য এই গাছ দিয়ে থাকেন। এছাড়াও কিছু বাগান মালিক ব্যাক্তিগত নার্সারি থেকেও চা গাছ সংগ্রহ করেন।
চা বোর্ড ও বাগান মালিকদের তথ্যমতে, এক একর জমিতে চা বাগান করার জন্য মাটির গুণগত মানের উপর ভিত্তি করে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার পর্যন্ত গাছের প্রয়োজন হয়। ৩ বছরের মধ্যে চা গাছগুলো পরিপূণ হয়, তবে চা উৎপাদনে সময় লাগে আরও ১ থেকে দেড় বছর ।
তারা আরও জানায়, এক একর জমিতে চা বাগানের পরিচর্যার জন্য বাৎসরিক ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে এবং গাছের পাতা থেকে প্রায় তিন লাখ টাকা পর্যন্ত তোলা যায়।
চা পাতা সংগ্রহের পরে বহিরাগত ব্যবসায়ীরা পাতার গুণমানের উপর ভিত্তি করে প্রতি কেজি ২০ থেকে ৩০ টাকা মূল্যে কিনে নেয়। তারপর তারা পাতাগুলো বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করে। পরে ফ্যাক্টরি থেকে প্রক্রিয়াকরণ শেষে নিলাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
উত্তরবঙ্গে নিলাম কেন্দ্র তৈরী
উত্তরবঙ্গের এসব এলাকায় নিলাম কেন্দ্র তৈরীর পরিকল্পনা করেছে সরকার এবং অধিক পরিমাণে চা বাগান করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে।
মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে চা নিলাম কেন্দ্র আছে মাত্র দুটি। একটি চট্টগ্রামে অন্যটি শ্রীমঙ্গলে। উত্তরবঙ্গের ফ্যাক্টরিগুলোকে নিলামের জন্য চট্টগ্রামে এবং শ্রীমঙ্গলে যেতে হয়।
তিনি আরও বলেন, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং সময় বাঁচানোর জন্য উত্তরবঙ্গে একটি নিলাম কেন্দ্র তৈরীর ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।পরবর্তী পদক্ষেপ
কুড়িগ্রামেচা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন; আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কুড়িগ্রামকে নিয়ে, কারণ সেখানের একটি বড় অংশ ছোট চা বাগান তৈরীতে আগ্রহী হচ্ছে।কুড়িগ্রামে অব্যবহৃত জমি এবং টোবাকো ফ্যামিং জমিগুলোতো চা বাগান করা জন্য মানুষদের উৎসাহিত করতে পেরেছি। এছাড়াও সেখানকার জমির গুণমান ভালো হলে চা উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে।
সর্বোপরি, দিন দিন মানুষ বুঝতে পারছে চা উৎপাদন করে অনেক লাভবান হওয়া সম্ভব; তাই তারা চা বাগানের জন্য মাটিগুলো প্রস্তুত করছে।