প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাহাজ ভাঙা শিল্পকে বিশ্ব দরবারে এগিয়ে রাখতে চান কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগকে পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ)।
বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় বিএসবিআরএ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তর কিছুদিন এটাকে তুলনামূলক কম দূষণকারী ‘কমলা’ শ্রেণির শিল্পে নিয়ে যায়। আবার সর্বোচ্চ দূষণকারী ‘লাল’ শ্রেণিভুক্ত করে। ফলে প্রধানমন্ত্রী জাপান সফরকালে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত সহযোগিতা স্মারকের মর্যাদাহানি হচ্ছে। এছাড়া লাল শ্রেণিভুক্ত করায় জাপান সরকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যে ঋণ দেয়ার চুক্তি হয়েছে সেটাও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু বে ভিউ’র মেজবান হলে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন নরওয়ের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। তখন বিএসবিআরএ এর সদস্যরা জাহাজ ভাঙা শিল্পকে লাল শ্রেণিভুক্ত করায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারের মধ্যে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে সেটার নিরসন চান। এছাড়া জাহাজ ভাঙা শিল্পকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছে নরওয়ের প্রতিনিধি দল।
মতবিনিময় সভায় ইয়ার্ড মালিকরা বলেন, এখন ইয়ার্ডগুলো অনেক বেশি অটোমেশন। অতীতে শোনা যেত, জাহাজ ভাঙায় কাজ করতে গেলে শ্রমিকরা মারা যেতেন। আর এখন সবক্ষেত্রে অটোমেশন করা হয়েছে। আগে যেখানে লোহা বহন করতো শ্রমিকরা। এখন সেটা মেশিনেই করছে। অটোমেশন হওয়ায় ১০ শতাংশ শ্রমিক কাজ করছে। বাকী ৯০ শতাংশ কাজ করছে মেশিন।
এদিকে জাহাজ ভাঙা শিল্পের পরিবেশ সুরক্ষা এবং কর্মরত শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে ইয়ার্ড মালিকরা জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজতকরণ করছেন। আরও উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করে এ শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ওর্গানাইজেশন (আইএমও) এর গাইডলাইন অনুযায়ী নরওয়েজিয়ান সরকারের অর্থ সহায়তায় নোরাড ফান্ড প্রজেক্ট এর আওতায় ইয়ার্ডের শ্রমিক-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রশিক্ষণ মডিউল প্রস্তুত এবং তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ৭০০ ইয়ার্ড শ্রমিকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং টিওটি কোর্সের মাধ্যমে ২০০ জন প্রশিক্ষিত ট্রেইনার তৈরি করা হয়েছে। এরপরও এ শিল্পকে লাল শ্রেণিভুক্ত হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের এমন সিদ্ধান্তের কারণে ইয়ার্ড মালিকরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বিশ্ব দরবারে।
নরওয়ের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেন, জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আসন্ন হংকং কনভেনশনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নরওয়ে সরকারের স্টেট সেক্রেটারি (ডেপুটি মিনিস্টার) এইচ. ই. রেঙ্গহিলড এসজনিয়ের সারস্তাদ বলেন, সীতাকুণ্ডে জাহাজ ভাঙা শিল্প পরিদর্শন করেছি। জাহাজ ভাঙা শিল্পের পরিবেশ সুরক্ষা এবং কর্মরত শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে আমি অভিভূত। আশা করছি বাংলাদেশ সরকার জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প সংক্রান্ত হংকং কনভেনশন (এইচকেসি) রেটিফাই করবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এইচ. ই. ইস্পেন রিক্তার সেভেন্ডসেন বলেন, আমি ৯ বছরে বেশ কয়েকবার চট্টগ্রামে এসেছি। তবে আজ ইয়ার্ডগুলো পরিদর্শন করে এটা বলতে পারি, এই শিল্প বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইয়ার্ড মালিকরা পরিবেশসম্মতভাবে তাদের ইয়ার্ডগুলো সাজিয়েছেন। আসন্ন হংকং কনভেনশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এই শিল্পকে আরও একধাপ নিয়ে যাবে।
পিএইচপি শিপ ব্রেকিং রিসাইক্লিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহুরুল ইসলাম রিংকু বলেন, হংকং কনভেনশনের গাইডলাইন অনুযায়ী জাহাজ ভাঙা শিল্প ক্রমান্বয়ে গ্রিন শিপ ব্রেকিং এবং রিসাইক্লিংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ৩টি ইয়ার্ড গ্রিন শিপ ব্রেকিং এবং রিসাইক্লিং ইয়ার্ডে উন্নিত হয়েছে। ইয়ার্ডগুলো গ্রিন শিপ ব্রেকিং এবং রিসাইক্লিং ইয়ার্ড হিসেবে ক্লাস-এনকে’র সনদ পেয়েছে। ধীরে ধীরে সবগুলো ইয়ার্ড গ্রিন শিপ হবে। সেটার জন্য এ শিল্পকে কমলা শ্রেণিভুক্ত করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরকালে গত ২৩ এপ্রিল জাপান সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে শিপ রিসাইক্লিং সংক্রান্ত একটি সহযোগিতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। জাপান সরকার বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙ্গার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ঋণ দেয়া চুক্তি হয়েছে। এ অবস্থায় এ শিল্পকে কমলা থেকে লাল শ্রেণিভুক্ত করায় হংকং কনভেনশন রেটিফিকেশনার উদ্যোগে নেতিবাচক প্রভাবের আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থার অবসান এবং পূর্বের নিয়মে সহজে শিপ রিসাইক্লিং কার্যক্রম পরিচালনা করাই আমাদের দাবি।
বিএসবিআরএ’র সভাপতি মো. আবু তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র উপদেষ্টা অ্যানি গ্ল্যাড ফ্যাডরিখসেন, নরওয়েজিয়ান জাহাজ মালিক সমিতির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হ্যারাল্ড সলবার্গ। আরও উপস্থিত ছিলেন বিএসবিআরএ’র উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন (অব.) এনাম চৌধুরী, সিনিয়র সদস্য শওকত আলী চৌধুরী, ভাইস প্রেসিডেন্ট জহুরুল ইসলাম রিংকু, ইসি সদস্য করিম উদ্দিন, সদস্য শওকত আলী চৌধুরী ও মো. তসলিম উদ্দিন প্রমুখ।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে নরওয়ে’র স্টেট সেক্রেটারি, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এবং নরওয়ে’র বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র এডভাইজারসহ দশ জনের একটি প্রতিনিধিদল সীতাকুণ্ডে বিভিন্ন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড পরিদর্শন করেন।