প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

গর্ভনিরোধকের বাজার

ঝিমিয়ে পড়েছে সরকারি উদ্যোগ, সুবিধায় বেসরকারি খাত

১৭ নভেম্বর ২০২১ ১৫:৫২:১৯ | আপডেট: ৩ years আগে
ঝিমিয়ে পড়েছে সরকারি উদ্যোগ, সুবিধায় বেসরকারি খাত

আব্দুর রাজ্জাক সোহেল

সরকারের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির তৎপরতা কমে যাওয়ায় বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর বাজার।

রাজধানীর লালবাগের গৃহবধূ তানিয়া আক্তার। তিনি বলেন, একসময় সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা বিনামূল্যে গর্ভনিরোধক দেয়ার জন্য বিবাহিত নারীদের খুঁজে বেড়াতো, কিন্তু এখন আমরাই তাদের খুঁজি।

তিনি বলেন, সরকারি গর্ভনিরোধক না পাওয়ায় এখন এসব সামগ্রী কিনতে হয়, যা আমার পক্ষে ব্যবহুল।

এসএমসি’র স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পণ্যের প্রধান মিজানুর রহমান দাবি করেন, ২০টি ব্র্যান্ডের গর্ভনিরোধক পণ্য সরবরাহ করে তারা মোট গর্ভনিরোধক সামাগ্রীর বাজারের ৬২ শতাংশ দখলে রেখেছেন। 

তিনি বলেন, আমরা বেশিরভাগই বড়ি, কনডম আর ইনজেকশন বিক্রি করি, যার পরিমাণ বছরে মোট ২৫০ কোটি টাকা। এসব পণ্যের বাজারের বার্ষিক গড় বৃদ্ধি ৪ শতাংশ।

২০১৮ সালে ডেমোগ্রাফিক এবং হেলথ সার্ভে বলছে, গর্ভনিরোধক বাজারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ৪৯ শতাংশ ধারণ করছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে ৪৪ শতাংশ। সরকার ও এনজিওগুলো বেশিরভাগ গর্ভনিরোধক বিনামূল্যে দিয়ে থাকে।

২০০৭ সালে এসব সামগ্রীর বাজারের ৪৫ শতাংশ দখলে ছিল বেসরকারি খাতের।

এসএমসি এন্টারপ্রাইজ, রেনাটা, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, জিস্কা ফার্মাসিউটিক্যালস, এবং প্রাণ-আরএফএল দেশীয় বাজারে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নুভিস্তা ফার্মা লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজার ফারজানা আক্তার পপি জানান, তাদের বার্ষিক পিল বিক্রির পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা এবং তা বছরে ১০ শতাংশ বাড়ছে।

বিডিএইচএসের তথ্য অনুসারে, গর্ভনিরোধক পিল ব্যবহারকারীদের ৪৩.৫ শতাংশ ফেমিকন, মিনিকন, ফেমিপিল, নর্ডেট-২৮, নোরেট-২৮ সহ এসএমসি পণ্য ব্যবহার করে। কিন্তু ৫১.৬ শতাংশ মানুষ সরকারের বিতরণ করা ব্র্যান্ড ‘সুখী’ ব্যবহার করে। এছাড়া, ৪.৯ শতাংশ ওভোস্ট্যাট, মারভেলন, লাইন্স, ব্রেডিকন, ডেসোলন এবং রোজেনের মতো বেসরকারি ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহার করছেন।

দেশীয় উৎপাদনের অবস্থা কী?

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশীয় উৎপাদকরা বড়ির চাহিদার পুরোটাই মেটাচ্ছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১ লাখ ৬৩ হাজার ২৬ ডলারের রাসায়নিক গর্ভনিরোধক রপ্তানি করেছে নেপালে।

বাংলাদেশ মূলত কনডমের জন্য বিশ্ববাজারের ওপর খুবই নির্ভরশীল। বিশেষ করে যেগুলো আমদানি করা হয়, মালয়েশিয়া, চীন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড আর যুক্তরাজ্য থেকে।

সরকার ২৫ মিলিয়ন মানুষকে বিনামূল্যে গর্ভনিরোধক পণ্য সরবরাহ করছে। ইমপ্লান্ট ব্যতীত সমস্ত গর্ভনিরোধক আইটেম দেশেই উৎপাদিত হয়।

পিলকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে কনডম

বাংলাদেশে ৮টি গর্ভনিরোধক পদ্ধতি রয়েছে, এর মধ্যে নারীদের জন্য ৬টি এবং পুরুষদের জন্য ২টি।

পিল এবং কনডম দুটি জনপ্রিয় গর্ভনিরোধক সামগ্রী। কিন্তু উৎপাদকরা বলছেন, আজকাল মানুষের মধ্যে কনডম-ই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

অনেক দম্পতি কনডম কেনেন। কারণ, নারীরা বড়ি খাওয়ার পর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার অভিযোগ করেন।

এসএমসির মিজানুর রহমান বলেন, প্রতি বছর কনডমের বিক্রি বাড়ছে ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে বিনামূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য অর্জন করলেও গত এক দশকে এ প্রচেষ্টায় ভাটা পড়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর মহাপরিচালক বলেন, গর্ভনিরোধক ব্যবহার ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৩.১ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৩.৪ শতাংশ ছিল৷

চক বাজারের ভাই ভাই ফার্মেসির মালিক মোহাম্মদ এয়াসিন বলেন, কয়েক বছর আগে জনস্বাস্থ্য প্রতিনিধি আমার দোকানের সামনে মানুষের মধ্যে জন্মনিরোধক সামগ্রী বিতরণ করতেন, কিন্তু এখন তা বন্ধ রয়েছে।

তিনি বলেন, মানুষ এখন আমাদের কাছ থেকেই গর্ভনিরোধক সামগ্রী কিনছে।

রয়ে গেছে চ্যালেঞ্জ

বিডিএইচএসের তথ্য বলছে, ৭৯.১ শতাংশ বিবাহিত নারী সন্তান ধারণের সক্ষমতা সংশ্লিষ্ট কারণে গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে চান না। তারা যতটা সম্ভব সন্তান নিতে চান। আর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার করণে তাদের স্বামী/সঙ্গীর বিরোধিতায় ৮.৯ শতাংশ নারী এসব ব্যবহার করতে অনিচ্ছা দেখান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ২০১১ সাল পর্যন্ত বিনামূল্যে গর্ভনিরোধক বিতরণের সুবিধা পেয়েছিল, কিন্তু সেই সময়কালের পরে এ কার্যক্রম কমে গেছে।

তিনি বলেন, জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি এসব সামগ্রী সরবরাহ এখন মারাত্মকভাবে কমে গেছে, যা গুরুত্বসহকারে সমাধান করা দরকার।

সাধারণত, পুরুষরা তাদের নারী সঙ্গীকে গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে বাধ্য করেন। কিন্তু পুরুষদেরও স্বেচ্ছায় এসব ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।