আক্তার। বয়স ৫০। পেশায় মোটরসাইকেল চালক। ৪৮ বছর ধরে বাস করছেন চরে। আগে ছিলেন টাঙ্গাইলের খোসকার চরে। বর্তমানে জামালপুরের নলসন্ধ্যা চরের বাসিন্দা তিনি। প্রায় ৩৫ বছর ধরে আছেন এখানে। বাবা ছিলেন পেশায় নৌকা চালক। বাবার হাত ধরে তিনিও সে পথ বেছে নেন। এরপর শুরু করেন ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রায় ১০ বছর চলে এভাবে। ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় ৭ বছর ধরে তিনি চরে মোটরসাইকেলে করে যাত্রী পরিবহন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
এ পেশায় আসার পর আমূল পরিবর্তন এসেছে মধ্যবয়সী আক্তারের জীবনে। এখন প্রতিদিন তার আয় গড়ে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা।
চার সন্তানের জনক আক্তারের এ আয়ে চলে সংসারসহ সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। এরই মাঝে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
এ গল্প শুধু আক্তারের নয়। চরের অনেক যুবকের। এমন-ই আরেক যুবক ফরিদুল ইসলাম। বয়স ২২ বছর। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর বাবার মৃত্যু হলে সংসারের হাল ধরেন। ফরিদুলের সংসারে এখন আর অভাব নেই।
ধু ধু চরে চলাচলে আগের মত ভোগান্তি পোহাতে হয় না জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার নলসন্ধ্যা চরের বাসিন্দাদের। তাদের কষ্ট লাঘব করেছে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল। পাশাপাশি কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক বেকার তরুণ-যুবকের।
সরেজমিনে দেখা যায়, নলসন্ধ্যার বেশিরভাগ রাস্তা সরু ও মাটির। রাস্তাগুলো গর্তে ভরা। ভাঙা, উঁচু-নিচু। বিস্তৃত বালুচর। যেদিকে চোখ যায় শুধু বালু আর বালু। কোথাও বাইক নিয়ে উঠতে হয় অনেক উপরে আবার কোথাওবা খাড়া ঢাল বেয়ে নামতে হয় নিচে। সেই বালুর মধ্য দিয়ে অত্যন্ত কৌশলে তারা চালিয়ে নিয়ে যান মোটরসাইকেল। এক সময় কর্মসংস্থানের অভাবে হতাশাগ্রস্ত ছিলেন এ এলাকার অনেক যুবক। মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করে তারাই এখন স্বাবলম্বী। পড়াশোনা শেষে বেকারত্ব ঘুচাতে বাইক চালিয়ে আয় করেন অনেকে। অভাব-অনটনে দিন কাটানো মানুষের মুখে ফুটেছে হাসি। দৈনিক খরচের পাশাপাশি সঞ্চয়ের খাতায় যোগ হচ্ছে অর্থ।
নলসন্ধ্যা চরে যাত্রী পরিবহনের জন্য মোট মোটরসাইকেল আছে ৪০টি। কেউ নগদ টাকায়, আবার কেউ কিস্তিতে কিনেছেন বাইক। বিকল্প এই কর্মসংস্থানে খুশি সেখানকার যুবকেরা। স্বস্তিতে স্থানীয় বাসিন্দারাও। তেমনই একজন আবুবকর। বাইকে চড়ে এসেছেন নদীর পাড়ে। নদী পেরিয়ে যাবেন সরিষাবাড়ী উপজেলায় মেয়ের বাড়িতে। বিজনেস পোস্ট’কে তিনি বলেন; আগে দুই পা ছাড়া চলাচলের কোনো উপায় ছিলো না। এখন আমরা বাইকে করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে পারি। এর ফলে রোগী পরিবহনও অনেকটা সহজ হয়েছে। টাকা কিছুটা বেশি খরচ হলেও কষ্ট কমেছে বলে মন্তব্য করেন ষাটোর্ধ্ব আবুবকর।
চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ছোট-খাটো দুর্ঘটনার নানা খবর। সেখানের অধিকাংশ চালকের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স, মাথায়ও থাকে না হেলমেট। ভৌগলিকভাবে প্রতিকূল চর এলাকা; এর ফলে প্রায়শই ঘটে দুর্ঘটনা। তেমনই এক দুর্ঘটনার কথা তুলে ধরেন শহীদুল নামের ২৫ বছরের এক যুবক। দিনটির কথা স্মরণ করে শহীদুল বলেন। চরের মধ্যে থাকা নদীর উপরে কাঠের ব্রিজটি পার হওয়ার সময় হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাইকসহ পড়ে যান নদীতে। এসময় বাইকের নিচে চাপা পড়েন তিনি। আশেপাশে কেউ না থাকায় পড়ে যান বিপাকে। দীর্ঘক্ষণের চেষ্টায় সক্ষম হন বাইকের নিচ থেকে বের হয়ে আসতে।
বাইক চালাতে গিয়ে বালুর মধ্যে যতটা না কষ্ট তার চেয়ে বেশি কষ্ট বর্ষাকালে কাদার মধ্যে হয় বলে উল্লেখ করেন এই যুবক। হাত-পা কাটা-ছেড়া, ব্যথা এসব নিত্যদিনের ঘটনা।
চালকরা জানান; গাড়ির মেরামত বাবদ প্রতি মাসে গুণতে হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। বর্ষা মৌসুমে এ খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা।
মোটরসাইকেলে করে একসাথে দু’জন যাত্রী পরিবহন করতে পারেন তারা। সেক্ষেত্রে দু’জনের জন্য ২০০ টাকা আর কেউ একা গেলে গুনতে হয় ১০০ টাকা।
এসব চালকদের দক্ষতার উন্নয়নে স্থানীয়দের দাবি চালকদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করলে নিরাপদে চলাচল করতে পারবেন যাত্রীরা।
আরও পড়ুন - মাসিক নিয়ে অকপটে কথা বলেন তারা